শত বাধা পেরিয়ে ঢাবির ১ম ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থী হওয়ার গল্প
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ জাহিদুল ইসলামের জন্ম হয়েছিল দরিদ্র পরিবারে। আর দশজন সাধারণ শিশুর মতো বেড়ে ওঠার সময় তিনি খেয়াল করলেন- দৈহিক গড়ন পুরুষের হলেও নিজের মধ্যে অনেক নারীসুলভ আচরণ-ব্যবহার রয়েছে। অন্য দশটা মেয়ের মতোই সংসার সাজানোর স্বপ্ন ছিল তার চোখে। পুতুল খেলা, রান্নাবাটি খেলা ও মেয়েদের মতো সাজগোজ করতে তার ভালো লাগতো।
কিন্তু সমাজ-পরিবার একজন ছেলের এমন বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই ভালো চোখে দেখেনি। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার চলতো। এমনকি পড়াশোনা করতে গিয়েও তাকে অনেক বাধাবিপত্তির মু্খোমুখি হতে হয়েছে। কেউ কেউ টিপ্পনী কেটে বলেছে, ওকে পড়াশোনা করিয়ে কী হবে!
কিন্তু সমাজ এবং পরিবারের ভয়ে তিনি নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দেননি। বহু কষ্টে টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন। হাজার চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর সেই পথে জাহিদুল ইসলাম থেকে রূপান্তরিত হয়েছেন আজকের অঙ্কিতা ইসলাম হিসেবে।
অঙ্কিতা ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থী। এ বছর তিনি শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ব্যবস্থাপনা বিভাগে এক্সিকিউটিভ এমবিএ করার সুযোগ পেয়েছেন। পেশাগত জীবনে অঙ্কিতা ইসলাম একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করছেন। উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে ভবিষ্যতে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করাই তার লক্ষ্য।
অঙ্কিতা ইসলামের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নান্দুরিয়ায়। বেলায়েৎ হোসেন বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর টাঙ্গাইলের সরকারি সা'দত কলেজে ভর্তি হয়ে গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। কিন্তু শিক্ষাজীবনের এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে তাকে বেশ প্রতিকূল পরিস্থিতির মু্খোমুখি হতে হয়েছে।
শিক্ষাজীবনের সেই কঠিন পরিস্থিতির স্মৃতিচারণ করে অঙ্কিতা জানান, পরিবারের অসহযোগিতা ছাড়াও তাকে সহপাঠীদের বুলিংয়ের শিকার হতে হতো। বাদ যায়নি শিক্ষকরাও। তবে সবচেয়ে কঠিন সময়টা গিয়েছে বয়ঃসন্ধিকাল পার করার সময়। একটা সময় স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার প্রসঙ্গে অঙ্কিতা জানান, স্নাতক সম্পন্নের পর স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) করার স্বপ্নও দেখতেন তিনি। স্নাতক শেষের পর ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরি করার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদনও করেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মৌখিক পরীক্ষায়ও (ভাইভা) উতরে যান তিনি।
যদিও সফলতা নিয়ে অঙ্কিতা নিজেই সন্দিহান ছিলেন। তার ভাষ্যমতে, ভাইভা দেওয়ার আগে আমার ভয় হচ্ছিল- স্যাররা আমাকে কীভাবে নেন। তবে স্যাররা যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন এবং সৌভাগ্যক্রমে আমি টিকে যাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে অঙ্কিতা বলেন, এখানে যে আন্তরিক পরিবেশ পেয়েছি, সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আমার যে ধারণা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তা বদলে দিয়েছে। এখানে সবাই আমাকে সহযোগিতা করেন। বিশেষ করে পড়াশোনার বিষয়ে শিক্ষকরা আমাকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। আর সহপাঠীরাও সব ধরনের সহযোগিতা করেন।
তিনি আরও বলেন, এটা শুধু আমার জন্য না, ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির জন্য বিশাল একটা জায়গা তৈরি হলো। নতুন একটা যাত্রা শুরু হলো। ভবিষ্যতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো আমার অন্য ট্রান্সজেন্ডার ভাই-বোনেরা পড়াশোনা করতে পারবেন। তারা অনুপ্রাণিত হবেন পড়াশোনা করার জন্য। আমি মনে করি, এর মাধ্যমে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও আমাদের (ট্রান্সজেন্ডার) প্রতি আরেকটু ইতিবাচক হবে।
দেশের সর্বস্তরে ট্রান্সজেন্ডারদের উপস্থিতি নিশ্চিতের জন্য সবার সচেতনতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে অঙ্কিতা বলেন, দেশের সার্বিক পরিবেশ অনুযায়ী ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সব ক্ষেত্রে ট্রান্সজেন্ডারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। যেমন, আমি এখন ব্যাংকে কাজ করছি। আমার ব্যাংকের সবাই জিনিসটাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে। সেভাবে সব ক্ষেত্রে ট্রান্সজেন্ডারদের উপস্থিতি থাকলে সহজেই মানুষের সচেতনতা তৈরি হবে।
নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে অঙ্কিতা বলেন, আমি আপাতত স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে চাই। এরপরও উচ্চশিক্ষা নেওয়ার ইচ্ছে রয়েছে। এছাড়া, দেশের ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির প্রায় ৯০% মানুষই উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত। আমি তাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করতে চাই।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০১/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়