লিডিং ইউনিভার্সিটির ভিসি’র বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
সিলেটের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটি। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. কাজী আজিজুল মওলার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ রাগীব আলী ভাইস চ্যান্সেলরের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও বিশ্ববিদ্যালয়ের
চ্যান্সেলর বরাবর। তার বিরুদ্ধে আনা ২০টি অভিযোগের মধ্যে অন্যতম স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বিদেশে অর্থ পাচার ও ইচ্ছাকৃতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতিসাধন ইত্যাদি।
এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে বসে অফিস পরিচালনা, ব্যক্তিগত ভ্রমণের নামে টিএ-ডিএ নেয়াসহ অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। কাজী আজিজুল মওলার বিরুদ্ধে গত ৬ই মার্চ ইউজিসিতে এসব অভিযোগ দাখিল করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ রাগীব আলী। একই অভিযোগের তদন্ত চেয়ে ২১শে মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্ট বরাবর আবেদন করেন তিনি।
অধ্যাপক ড. কাজী আজিজুল মওলা বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। তার পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম এক টালমাটাল অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। অভিযোগের আলোকে দেখা যায়, ইউজিসি গতবছরের ২৯শে নভেম্বর সুনির্দিষ্ট শর্তাধীনে ইউজিসি ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. কাজী আজিজুল মওলাকে বিদেশ যাওয়ার জন্য একটি অনুমতি প্রদান করেন। এতে বলা হয়, ভাইস চ্যান্সেলরের অনুপস্থিতিতে ট্রেজারার সেই দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু তিনি সেই আদেশ অমান্য করেন।
শুধু তাই নয় ২০২১ সালের ১লা মার্চ ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে যোগদানের পর তিনি চারবার যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে তিনি ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত ছিলেন। ড. কাজী আজিজুল মওলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর থাকাকালে কাউকে দায়িত্ব দিয়ে যাননি এবং অনলাইনে দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে আয়কর ফাঁকিরও। তিনি ১লা মার্চ ২০২১ থেকে ৩১শে জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিল থেকে নির্ধারিত বেতনের অতিরিক্ত মোট ১৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়াও তিনি এই সময়ে টিএ/ডিএ বাবদ অনৈতিকভাবে এক লাখ ১২ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা নির্ধারিত থাকলেও তিনি ২০ শতাংশ ভাতা উত্তোলন করেছেন।
তিনি তার দায়িত্বে যোগদানের পর দুই বছরের মধ্যে প্রায় এক বছর লিডিং ইউনিভার্সিটিতে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থেকেছেন। কাজী আজিজুল মওলা লিডিং ইউনিভার্সিটিতে যোগদানের ১ম বছরে বিধিবহির্ভূতভাবে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার উৎসব ভাতা বাবদ তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা তুলেছেন বলে অভিযোগ করা হয়। এ ছাড়াও তিনি গতবছরের ১৯শে জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ এর ধারা ৪৪ (৬) সম্পূর্ণরূপে লঙ্ঘন করে দুই হাজার পাঁচশ’ পাউন্ড অর্থ লিডিং ইউনিভার্সিটির সাধারণ তহবিল থেকে যুক্তরাজ্যের একটি কোম্পানির অ্যাকাউন্টে প্রেরণ করেন।
এই লেনদেন সম্পূর্ণরূপে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অন্যায়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৬৯তম সিন্ডিকেট সভা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের ২১তম সভার সুপারিশ ও সিদ্ধান্তক্রমে বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়টি বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের নজরে এনে কাজী আজিজুল মওলার বিরুদ্ধে বিগত ৫ই মার্চ লিখিতভাবে অভিযোগ দায়ের করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ও বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন সচিব বনমালী ভৌমিক কানাডা ও আমেরিকা যাওয়ার জন্য শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করার অনুমতির জন্য ভাইস চ্যান্সেলর ড. কাজী আজিজুল মওলাকে একটি ভিআইপি পাস দেয়ার অনুরোধ করেন।
বনমালী ভৌমিক অভিযোগ করেন, ভাইস চ্যান্সেলর কাজী আজিজুল মওলার নির্দেশে উক্ত চিঠিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে ‘জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর কারণে আমাকে নানাবিধ আইনি জটিলতায় পড়তে হয়।
ভাইস চ্যান্সেলরের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন রেজিস্ট্রার মেজর (অব.) শাহ আলম কর্তৃক এক কোটি পাঁচ লাখ টাকার আর্থিক দুর্নীতির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অফিসে লিখিতভাবে অভিযোগ উত্থাপন করা হলেও কাজী আজিজুল মওলা সহায়তা ও সুরক্ষা প্রদান করেন। যার কারণে এই অর্থ পরিশোধের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব শাখার তৎকালীন ইনচার্জ রজত কান্তি চক্রবর্তী কর্তৃক সংঘটিত আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে কারণ ব্যাখ্যার জন্য ভাইস চ্যান্সেলরের অনুমতি প্রার্থনা করলে কাজী আজিজুল মওলা অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতি সপ্তাহে গড়ে তিন/চার দিন নিয়মিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত থাকেন। কোনো বিশেষ কারণে শুক্র-শনিবার ক্যাম্পাসে থাকলেও অন্যদিন অনুপস্থিত থেকে তার অনুপস্থিতির সংখ্যা বজায় রাখেন। এ ছাড়াও তিনি গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি বিধিমালা নামে সকলের জন্য অবশ্য পালনীয় বিধিমালা আরোপ করেন। এতে ‘ইন দ্য ইন্টারেস্ট অব দ্য সিকিউরিটি অফ ইস্ট পাকিস্তান’ লিখে আদেশটি জারি করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির পাবলিক হেলথ বিভাগে রীতিমতো শিক্ষার্থী শূন্য হয়ে পড়েছে। জানা যায়, ওই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অহেতুক যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলা হয়। অপরদিকে শফিকুল ইসলামের দুটি কিডনি ৮০ শতাংশ অকার্যকর এবং তিনি অনেকটা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। এসব নানা কারণে অনেক বিভাগের শিক্ষকরা চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রুপিং চরম আকার ধারণ করেছে তার কারণে। অভিযোগ রয়েছে অভ্যন্তরীণ মিটিংয়ে তিনি সরাসরি বলেন, আমি যেকোনো সময় যে কাউকে বরখাস্ত করে চাকরিচ্যুত করতে পারি। এ ছাড়াও অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কাজে ইউজিসি’র এখতিয়ার নেই। এমনটাও বলেন মিটিংয়ে।
আইন মোতাবেক গঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রয় কমিটি এবং ক্যাম্পাস উন্নয়ন কমিটিকে এড়িয়ে গিয়ে আজিজুল মওলা নীতিবহির্ভূতভাবে এবং অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন পাকা-আধাপাকা স্থাপনা নির্মাণের নামে আর্থিক অস্বচ্ছতা ও সীমাহীন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছেন। একারণে প্রায় দেড় কোটি টাকার অধিক আর্থিক ক্ষতিসাধন করেছেন। এমনকি তিনি নিজের বেতন- ভাতা অতিরিক্ত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ নিজে নিজেই স্বাক্ষর করে উত্তোলন করেছেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে, ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. কাজী আজিজুল মওলা বলেন, আমাকে প্রমাণসহ বলুক আমি জবাব দেবো।
ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, আমরা দুই পক্ষের অভিযোগ আমলে নিয়েছি। ইউজিসি বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করবে এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/৩০/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়