লাইলাতুল কদরের রাত চিনার উপায়
।। ড. মুহাম্মদ কামাল উদ্দীন।।
‘শব’ বা ‘লাইল’ অর্থ রাত। আর ‘কদর’ অর্থ মর্যাদা। শবে কদর বা লাইলাতুল কদর অর্থ ‘মর্যাদার রাত’। কোনো কোনো আরবি অভিধানের বর্ণনা মতে ‘কদর’ শব্দের অর্থ ‘ভাগ্য’ ধরে এ রাতকে ‘ভাগ্য নির্ধারণ রজনী’ও বলা হয়। লাইলাতুল কদরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো- এ রজনীতে ঐশীগ্রন্থ পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।
সূরা কদরের (১-৫)আয়াতে আল্লাহ মহান ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি পবিত্র কোরআনুল কারীমকে লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ করেছি। আপনি কি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হলো- হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রাত। এ রাতে ফেরেশতাগণ ও জিবরাঈল (আ.) তাদের প্রতিপালকের নির্দেশে প্রত্যেক বিষয় নিয়ে অবতীর্ণ হন। এটা এক শান্তিময় রজনী- যা ফজর উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’
লাইলাতুলকদরকবে?
নির্দিষ্ট করে ‘লাইলাতুল কদর’ চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। কারণ এ রজনীকে নির্দিষ্টকরণমূলক কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। অনেকেই মনে করেন, ২৬ রমজান দিবাগত রাতটিই লাইলাতুল কদর। এমনটা ধারণা করা কোনোভাবেই সঠিক নয়। পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকের যে কোনো একটি বেজোড় রাতই ‘শবে কদর’ হতে পারে। নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে, অতঃপর আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতসমুহে তা খোঁজ করবে।’
রাসুল (সা.) এ বিষয়ে বলেছেন, ‘রমজানের শেষ দশ দিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ কর।’ উল্লেখিত হাদীসের আলোকে যে বিষয়টি প্রতিয়মান হয়, তা হলো- নির্দিষ্টভাবে রমজানের কোনো একটি রাতকে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর বলা যাবে না। বরং পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকের যে কোনো একটি বেজোড় রাত শবে কদর বা লাইলাতুল কদর হতে পারে।
রমজানের ২৭তম রজনী অর্থ্যাৎ ২৬ রমজান দিবাগত রাতটি লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। কদরের রাত হওয়ার বিবেচনায় দ্বিতীয় সম্ভাবনাময় রাত হলো-২৫, তৃতীয় হলো-২৯, চতুর্থ হলো-২১, পঞ্চম হলো-২৩ বিজ্ঞ উলামাগণ বলেছেন, মহিমান্বিত এ রজনীটি স্থানান্তরশীল। অর্থাৎ প্রতি বৎসর একই তারিখে বা একই রজনীতে তা স্থির থাকে না।
শবে কদর কেন এতোটা গুরুত্বপূর্ণ?
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে তার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সওয়াবের আশায় ইবাদত করবে তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’
তাফসীরে মারেফুল কোরআন ও তাফসীরে মাজহারিতে উল্লেখ হয়েছে, ‘রাসুল (সা.) একবার সাহাবায়ে কেরামকে বনী ইসরাইলের একজন আবিদ ও জাহিদ ব্যক্তির আমল-আখলাকের ঘটনা শুনাচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, সেই আবিদ ব্যক্তি হাজার মাস বিরতিহীনভাবে সারারাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী, জিকির-আজকার করতেন এবং সারাদিন সিয়াম পালন করতেন ও আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করতেন।
সাহাবা আজমাইনরা ঐ ব্যক্তির আমলের বর্ণনা শুনে নিজেদের স্বল্প আয়ূর কথা স্মরণ করে আফসোস করছিলেন। এমন সময় সূরা কদর নাজিল হলো এবং তাতে ইরশাদ হলো-‘হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হচ্ছে লাইলাতুল কদর।’ অর্থাৎ মাত্র একটি রাত না ঘুমিয়ে ইবাদত-বন্দেগী, জিকির-আজকারসহ বিভিন্ন নেক আমলে সময় কাটাতে পারলে হাজার মাস লাগাতার ইবাদত করার চেয়েও অনেক বেশি সওয়াব অর্জন করা সম্ভব হতে পারে।
এক হাজার মাস =৮৩ বছর চার মাস। একটি রাত ইবাদাতে কাটানো সম্ভব হওয়া মানে ৩০ হাজার ৪১৫ দিন ও রাত ইবাদাতে মশগুল থাকার সাওয়াব-সৌভাগ্য অর্জন করা। মাত্র একটি রজনী অর্থ্যাৎ মাগরিবের নামাজের পর থেকে ফজরের নামাজ পর্যন্ত আনুমানিক মাত্র ১০ থেকে সাড়ে ১০ ঘন্টা সময় আমল-ইবাদতে কাটানো সম্ভব হওয়া মানে ৭ লাখ ২৯ হাজার ৯৬০ ঘন্টা, ৪ কোটি ৩৭ লাখ ৯৭ হাজার ৬০০ মিনিট অথবা ২৬ কোটি ২৭ লাখ ৭৬ হাজার সেকেন্ড লাগাতার আমল-ইবাদতে সময় ব্যয় করার নিশ্চিত সাওয়াব-সৌভাগ্য অর্জন করা।
মহিমান্বিত শবে কদর বা লাইলাতুল কদরে ১০ ঘন্টা আমল-ইবাদতে সময় কাটানো সম্ভব হওয়ার হিসেব মোতাবেক এ রজনীতে মাত্র ১ সেকেন্ড ইবাদাত করা মানে অন্য সময়ে ২০ ঘন্টা ইবাদতে কাটানো। এ রাতে মাত্র ১ মিনিট আমলে মশগুল থাকা মানে অন্য সময়ে ৫০ দিন লাগাতার আমলে মশগুল থাকার সমান। মহিমান্বিত এ রজনীতে মাত্র ১ ঘন্টা আমল-ইবাদতে সময় ব্যয় করা মানে অন্য সময়ে ৮ বছর ৩৩ দিন বা ৭২ হাজার ৯৯৬ ঘন্টা আমল-ইবাদতে সময় ব্যয় করার সমান।
কদরের রাত চেনার কোনো আলামত আছে কী?
যে রাতটি লাইলাতুল কদর হবে সেটা চেনার কিছু আলামত বা কিছু নিদর্শনের কথা বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। বোখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ ও ইবনে খুমাইমাসহ বিভিন্ন হাদীসের গ্রন্থে এ রাতের মোট ১০টি আলামত বা নিদর্শনের কথা আলোচিত হয়েছে। সেগুলো হলো-
১: রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের শেষ দশ দিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ করো।’ এই হাদীস দ্বারা এ রাতটির তিনটি আলামত নির্ণিত হয়— ক. রাতটি রমজান মাসে হবে। খ. রমজানের শেষ দশকে হবে। গ. শেষ দশকের বেজোড় রাত হবে।
২: রমজানের শেষ সাত দিনে এ রাত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। রাসুল (সা.) থেকে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়, তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করতে চায়, সে যেন রমজানের শেষ সাত রাতে তা অন্বেষণ করে।’
৩: রমজানের ২৭তম রজনী অর্থ্যাৎ ২৬ রমজান দিবাগত রাতটি লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। মুসলিম শরীফে এসেছে, রাসুল (সা.) থেকে হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বর্ণনা করে বলেন, ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যতদূর জানি রাসুল (সা.) আমাদেরকে যে রজনীকে কদরের রাত হিসেবে কিয়ামুল্লাইল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন; তা হলো- রমজানের ২৭ তম রাত।’
৪: রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না। অর্থাৎ এ রাতের অন্ধাকারচ্ছন্নতা অন্য রাতের তুলনায় কম হবে।
৫: সে রাতের আবহাওয়া হবে নাতিশীতোষ্ণ। অর্থাৎ গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না সে রাতে।
৬: মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে গোটা রাত জুড়ে।
৭: সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে।
৮: কোনো ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ মহান স্বপ্নে রাতটির কথা হয়তো জানিয়েও দিতে পারেন।
৯: ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণও হতে পারে।
১০. এক ধরনের পরিবেশ বিজার করবে যা অতি অতীতে লক্ষ্য করিনি।
১১: সে রাতের সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে। সেদিন সকালের প্রথম সূর্যটি হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো।
নিশ্চিতভাবে শবে কদর লাভের কোনো আমল-নিশ্চতভাবে শবে কদর লাভ করা অত্যন্ত সৌভাগ্যজনক একটি বিষয়। রমজানের কোন রাতটি শবে কদর বা লাইলাতুল কদর হবে সেটা যেহেতু নিশ্চিত বা সুচিহ্নিত নয় সুতরাং নিশ্চিতভাবে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির দাবী করাও খুব কঠিন। তবে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করার মাধ্যমে অনেকটাই নিশ্চিতভাবে মহিমান্বিত এই রজনীটি লাভ করা সম্ভব হতে পারে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ। কারণ ইতিকাফ করার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো- শবে কদর প্রাপ্তি। সুতরাং রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করার মাধ্যমে শবে কদর প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়।
এ রাতে মুসলিম হিসেবে করণীয়, বর্জনীয় কী?
মহিমান্বিত এ রজনীতে প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য করণীয় কিছু আমল রয়েছে। কারণ এ রাতটি বছরে একবারই আসে এবং একটি কদরের রাত পাওয়ার অর্থ হলো- হাজার মাস একনিষ্টভাবে মহান প্রভূর ইবাদত কাটানোর সৌভাগ্য অর্জন করা।
সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের প্রথম করণীয় হলো- পবিত্র রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি বেজোড় রাত যেকোনো মূল্যে ইবাদত-বন্দেগীতে কাটানোর নিয়ম করে প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
দ্বিতীয় করণীয় হলো- প্রতিটি বেজোড় রাতে মাগরিব, ইশা এবং ফজরের নামাজ অবশ্যই জামাতের সঙ্গে মসজিদে আদায় করা।
তৃতীয় করণীয় হলো- সালাতুত তাসবীহ ও বিভিন্ন নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকারসহ যে কোনো ধরনের নেক আমলে সময় কাটানো।
চতুর্থ করণীয় হলো- বেশি বেশি তাওবা-দোয়া-মোনাজাত করা। তিরমিজি শরীফের ৩৫১ নং হাদীসে এসেছে, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘একদা আমি রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি কদরের রাত সম্পর্কে অবহিত হতে পারি; তবে আমি কি করব? তখন রাসুল (সা.) আমাকে এই দোয়া পাঠ করার জন্য বললেন। দোয়াটি হলো: (আরবি উচ্চারণ) ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফু আন্নি’-অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন আপনি। অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ এ রাতে দান-সাদাকাহ করাকেও অধিক উত্তম বলা হয়েছে।
পরিশেষ রাসুল (সা.)-এর কিছু হাদীস স্মরণ করিয়ে দেই। ইবনে মাজাহ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ‘শবে কদর’ থেকে বঞ্চিত হলো; সে যেন সমগ্র কল্যাণ থেকে পরিপূর্ণ বঞ্চিত হলো।’ হে আমাদের আল্লাহ! আপনি তো জানেন আমরা দূর্বল। আমাদের আমল গুলোকে কবুল করুন।আমাদের, আমাদের পরিবার, মেহেরবান মা-বাবা, আত্নীয় স্বজনকে আপনি ক্ষমা করে দিন। এই রজনী লাভের পরম সৌভাগ্য দিন। এই রজনীর কারণে আমাদের অতীতের সকল ভুল ক্ষমা করুন, আগামীর পথচলা সহজ করুন। সকল বিপদ-আপদ থেকে আমাদের হেফাজত করুন।
লেখক- শিক্ষাবিদ ও গবেষক