স্কুল-কলেজেও থেমে নেই র্যাগিং, বুলিং ও যৌন হয়রানি
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, স্কুল-কলেজেও থেমে নেই র্যাগিং, বুলিং ও যৌন হয়রানি। এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিরোধে প্রতি স্কুলে কমিটি থাকলেও তা শুধু কাগজে-কলমেই। ফলে সরকারের উদ্যোগ তেমন কাজে আসছে না। শিক্ষাঙ্গনে এমন ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। ইউনিসেফের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি চার শিক্ষার্থীর একজন সমবয়সীদের কাছে বুলিংয়ের শিকার হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্কুল-কলেজে র্যাগিং, বুলিং ও যৌন হয়রানি ঘটলেও সেগুলো অভিযোগ হিসেবে লিপিবদ্ধ হচ্ছে না। সাধারণত স্থানীয়ভাবে এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা মীমাংসা করা হচ্ছে। কখনও কখনও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), জেলা ও থানা শিক্ষা অফিসে দু’একটি অভিযোগ জমা পড়লেও শিক্ষা কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা না থাকায় তদন্ত করতে গিয়ে তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন। সম্প্রতি পুরান ঢাকার সেন্ট্রাল গার্লস স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী শ্রেণি শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। এ ঘটনায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি ও ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগে বলা হয়, ওই শ্রেণি শিক্ষক আগেও নারী নির্যাতনের অভিযোগ ও যৌন হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন। তিনি ক্লাসের ছাত্রীদের জোর করে নিজের কোচিংয়ে পড়তে বাধ্য করেন। কোনো শিক্ষার্থী তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় না। এ অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে ঢাকা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল মজিদ বলেন, এই ধরনের অভিযোগ আসা মাত্রই তদন্ত করা হয়। অভিযোগ প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, ঢাকা জেলা ও মহানগরীতে সরকারি-বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজ এবং মাদ্রাসা মিলিয়ে ১১০৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং-বুলিং, যৌন হয়রানি, জঙ্গি ও মাদক মিলিয়ে চারটি কমিটি থাকার কথা। এর মধ্যে মাত্র ৪১৭টিতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধক কমিটি রয়েছে। তবে এসব কমিটির জোরালো কোনো কার্যক্রম নেই। ঢাকার বাইরে এই ধরনের কমিটির প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের আগ্রহ আরও কম।
এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (বিদ্যালয়) দুর্গা রানী সিকদার বলেন, ‘এমন ঘটনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটছে এবং সেখানেই মীমাংসা হচ্ছে। অনেকে লোকলজ্জা ও হয়রানির ভয়ে অভিযোগ দিতে সাহস করে না।’ শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, এসব ঘটনায় সরকারি বা এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সেই সুযোগও থাকে না। সরকারি শিক্ষক অভিযুক্ত হলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এমপিওভুক্ত শিক্ষকের ক্ষেত্রে তাঁর এমপিও বন্ধ করা হয়। তবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি তখন ব্যবস্থা নেয়। নীতিমালা না থাকার কারণে এসব ঘটনা কমানো সম্ভব হচ্ছে না।
জানা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে এখনও তা খসড়া পর্যায়ে আটকে আছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের একটি শাখা এ নিয়ে কাজ করছে।
মাউশির যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কামরুন নাহার বলেন, যৌন প্রতিরোধ বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালার কাজ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে অগ্রগতিও সন্তোষজনক। যা আছে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালার খসড়ায়: সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানিমুক্ত পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে খসড়া নীতিমালায় একাধিক প্রস্তাব রাখা হয়। কোনো শিক্ষার্থী বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী সহকর্মীকে পর্নোগ্রাফি প্রদর্শন, অনৈতিক প্রস্তাব, অশালীন মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি, প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি বা চাপ প্রয়োগ, ব্ল্যাকমেইল বা চরিত্র হননের জন্য ছবি বা ভিডিও প্রকাশ ইত্যাদিকে যৌন হয়রানি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো শিক্ষার্থী নানা মাধ্যমে এসব বিষয়ে অভিযোগ দিতে পারবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন রাখতে হবে। এই সংশ্লিষ্ট কমিটি ছাড়া কারও কাছে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা যাবে না। অভিযোগ গ্রহণকারী কমিটি ৩০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবে। তবে কেউ যদি মিথ্যা অভিযোগ করে, তবে কমিটি তার বিরুদ্ধেও শাস্তির প্রস্তাব করতে পারবে। কমিটিতে পাঁচ সদস্য থাকতে হবে। এর মধ্যে অন্তত দু’জন হবেন নারী। র্যাগিং-বুলিংয়ের নীতিমালা কতদূর: ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যার পর ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি আদেশ দেন হাইকোর্ট। আদেশে ‘বুলিং’ ও শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায় নির্ণয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরির জন্য অতিরিক্ত শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন আদালত। নির্দেশ অনুযায়ী এই কমিটি একটি নীতিমালা খসড়া করে ২০১৯ সালে আদালতে জমা দেয়। এরপর কয়েক দফা সংশোধন, পরিমার্জন, সংযোজন-বিয়োজন হলেও এখন পর্যন্ত তা চূড়ান্ত হয়নি। সর্বশেষ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই নীতিমালা চূড়ান্ত করতে গত জানুয়ারিতে একটি সভার আয়োজন করে।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান বলেন, নীতিমালা চূড়ান্ত করতে আরও দু’তিনটি সভা করা প্রয়োজন। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৪/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়