রোজার জন্য নিয়ত জরুরি
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
আজ মাহে রমজানের পঞ্চম দিন। সিয়াম শব্দের অভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। কিন্তু ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহকারে পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম। বিনা নিয়তে সারা দিন এমনকি আরো দীর্ঘ সময় ধরে পানাহার ইত্যাদি বর্জন করলে তা শরিয়তের দৃষ্টিতে সিয়াম বা রোজা বলে গণ্য হবে না। নিয়তের শর্ত যেকোনো ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
বুখারি ও মুসলিম শরিফসহ হাদিসের উল্লেখযোগ্য প্রায় প্রতিটি গ্রন্থে হজরত ওমর ফারুক রা: থেকে বর্ণিত এ হাদিসটি সঙ্কলিত হয়েছে যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আমলসমূহ বিবেচিত হয় নিয়তের ভিত্তিতে এবং ব্যক্তির জন্য তা-ই হয় যা সে নিয়ত করে। সুতরাং যার হিজরত হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে, তাঁর হিজরত তো হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে।
আর যার হিজরত হয় দুনিয়া অর্জনের কিংবা নারীকে বিয়ের উদ্দেশ্যে, তার হিজরত হয় সে-ই উদ্দেশ্যে। এই অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবহ ও নীতিসূচক হাদিসের আলোকে ইবাদত, জীবনাচার, কায়কারবার, লেনদেন এমনকি শিষ্টাচার ও সৌজন্যের ক্ষেত্রেও নিয়তের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সাব্যস্ত হয়।
তেমনি এসবের প্রতিদান ও মূল্য নির্ধারণেও নিয়তের প্রভাব প্রমাণিত হয়। ইবাদতের শুদ্ধতা ও প্রতিদানের মাত্রা নির্ধারিত হয় নিয়তের ভিত্তিতে। অন্যান্য ক্ষেত্রে শুদ্ধতার শর্ত না থাকলেও পরকালীন প্রতিদানের জন্য নিয়ত বিবেচ্য। রমজানের সিয়াম পালন ইসলামের পাঁচ বুনিয়াদের একটি। অতএব সিয়ামের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশুদ্ধতার জন্য নিয়তের শর্ত অনস্বীকার্য। তবে রোজার নিয়ত কখন করতে হবে, তা একটি প্রশ্ন।
তিরমিজি শরিফে উম্মুল মুমিনিন হজরত হাফসা রা: থেকে বর্ণিত আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি রাত থাকতেই রোজার দৃঢ় ইচ্ছা করল না, তার রোজা হয় না। এ হাদিসের মর্মের সাধারণত্ব থেকে অনুমিত হয়, সব ধরনের রোজার জন্য রাত থাকতেই বা সুবহে সাদিকের আগে নিয়ত করা জরুরি। তবে আল্লাহর রাসূলের বাস্তব ক্রিয়াকলাপে তার এই উক্তির সাথে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
বুখারি শরিফে হজরত সালামা ইবনুল আকওয়া রা: থেকে বর্ণিত আছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তিকে এ মর্মে ঘোষণা করার আদেশ দিয়েছিলেন যে, কেউ খেয়ে থাকলে সে যেন দিনের অবশিষ্ট অংশ রোজা রাখে। আর যে ব্যক্তি খায়নি, সে যেন রোজা রাখে।
কেননা আজ আশূরার দিন। এটা সেই সময়কার কথা যখন আশূরার দিনে রোজা রাখা আবশ্যিক ছিল। দিন শুরু হওয়ার পরেও ফরজ রোজার নিয়ত শুদ্ধ হওয়ার পক্ষে এ হাদিস একটি জোরাল প্রমাণ। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ায় এ নিয়ম এখন রমজানের রোজার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
গূঢ়ার্থ হচ্ছে, শরিয়তের পক্ষ থেকে এ দিনগুলো রোজার জন্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। তাই যে মুমিন ব্যক্তির দিন শুরু হয়েছে পানাহার ও কামাচার বর্জনের মাধ্যমে, রোজার পরিপন্থী কোনো কিছু না করা পর্যন্ত কার্যত সে রোজা পালন করেছে। দিন শুরু হওয়ার পরে যখন সে নিয়ত করল, তখন তা পাকাপোক্ত হয়ে গেল। মোটকথা দিন নির্দিষ্ট হওয়া একটি প্রভাবক। এখানে এই নির্দিষ্টতা হয়েছে শরিয়তের পক্ষ থেকে ।
যদি নির্দিষ্টতা হয় রোজাদার ব্যক্তির পক্ষ থেকে, যেমনটি হয়ে থাকে নির্দিষ্ট দিন বা দিনসমূহের রোজার মান্নতের ক্ষেত্রে, তা হলেও এই গূঢ়ার্থের ভিত্তিতে দিন শুরু হওয়ার পরেও নিয়তের অবকাশ সাব্যস্ত হয়। রমজানের ও নির্দিষ্ট দিনের মান্নতের- এই দুই প্রকারের রোজার নিয়ত দিন শুরু হওয়ার পরেও গণ্য সাব্যস্ত হলো।
তৃতীয় প্রকারে রয়েছে নফল রোজা । তিরমিজি শরিফে বর্ণিত আছে, উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা: বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন আমার ঘরে এসে বললেন, তোমাদের কাছে (খাবারের) কিছু আছে কি? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তাহলে আমি রোজা রাখলাম।
এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হলো- নফল রোজার নিয়ত দিন শুরু হওয়ার পরেও করা যায়। এই তিন প্রকার ছাড়া আরো তিন প্রকারের রোজা রয়েছে। যথা-রমজানের কাজা, কাফফারা ও অনির্দিষ্ট দিনের মান্নতের রোজা। এই তিন প্রকারের রোজায় একটি বিষয়ে অভিন্নতা রয়েছে। তা হলো- রোজার দিন অনির্দিষ্ট হওয়া।
তাই এই তিন ধরনের রোজার নিয়ত সুবহে সাদিকের আগেই হওয়া জরুরি। সুবহে সাদিক হওয়ার পরে রমজানের কাজা, কিংবা কাফফারা কিংবা অনির্দিষ্ট রোজার নিয়ত করলে সেই রোজা আদায় হবে না। প্রসঙ্গক্রমে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। নিয়তের অর্থ মনস্থির করা যে, আমি আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য বা আমার দায় আদায়ের জন্য আজ রোজা রাখছি। এটি একটি মানসিক ক্রিয়া। নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা জরুরি নয়।
তেমনি নিয়তের জন্য নির্ধারিত পাঠও নেই। তবে কেউ তা মুখে উচ্চারণ করলেও দোষ হবে না। ‘নাওয়াইতু আন আছুম্মা গাদাম মিন শাহরি রামাদানাল মুবারাকি ফরজাল লাকা ইয়া আল্লাহু, ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আনতাস সামিউল আলিম’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, মহিমান্বিত রমজান মাসে তোমার ফরজ হিসেবে আগামীকাল আমি রোজা রাখার নিয়ত করলাম।
অতএব তুমি আমা থেকে তা কবুল করো। নিশ্চয় তুমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ- রোজার নিয়ত হিসেবে এ ধরনের একটি পাঠ প্রচলিত আছে । বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে এটি একটি সুন্দর রচনা। কিন্তু এটি জরুরি বিষয় নয়। তবে কেউ মনস্থির করতে সহায়ক মনে করে অর্থ বুঝে এটি পাঠ করলে দোষের কিছু হবে না।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/জামান/১৬/০৩/২০২৪