রিক্সা চালিয়ে স্ত্রীকে এমএ পাস করালেন ফেরদৌস
ঢাকাঃ কনকনে শীত, গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুর বা ঝড়, বৃষ্টি কোনোটাই থামাতে পারেনি ফেরদৌসকে। স্ত্রীকে দেওয়া কথা রেখেছেন শত বাধা বিপত্তি ও কষ্টকে ছুড়ে ফেলে। তীব্র শীত বা দাবদাহের মাঝে রিক্সার প্যাডেল ঠেলতে পা ও হাত অসাড় হয়ে আসলেও কখনো দমে যাননি তিনি। কারণ প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে। শত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে রিক্সা চালিয়েই প্রতিশ্রুতি রেখেছেন। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে স্ত্রীর জন্য এখন চাকরি খুঁজছেন তিনি। মাঝে মাঝে চাকরির খোঁজ ও চাকরির আবেদনের জন্য নিজের রিক্সায় স্ত্রীকে নিয়ে আসেন শহরে।
অনেক সময় রিক্সায় ওঠা যাত্রীদেরও জিজ্ঞেস করেন কোন দপ্তরে নিয়োগ বা চাকরির শূন্য পদ রয়েছে? রিক্সা চালাতে চালাতে এভাবেই উচ্চ শিক্ষিত স্ত্রীর জন্য চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছেন বগুড়ার রিক্সাচালক ফেরদৌস ম-ল। স্ত্রীর লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার জন্য রিক্সা চালানো, গল্প-উপন্যাসে ফেরদৌসকে কোনো কাল্পনিক চরিত্র মনে হলেও বগুড়ার এই রিক্সাওয়ালা মোটেও তা নয়। যেন উপন্যাসের পাতা থেকে নেমে এসে তপ্ত রাজপথে কপালের ঘাম মোছার সঙ্গে প্রচণ্ড শীতে লড়াই করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর এক অদম্য চেষ্টার প্রতীক।
তার মাস্টার্স পাস করা স্ত্রী সীমানুর খাতুনও এক সংগ্রামী চরিত্র। জীবনের একটাই লক্ষ্য তার এখন। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ক্লান্ত স্বামীকে একটু বিশ্রাম দিয়ে সংসারের হাল ধরা। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও রিক্সাচালকের স্ত্রীর পরিচয় দিতে তার একটুও খারাপ লাগে না, বরং স্বামীকে নিয়ে তার গর্ব যে তিনি এমন একজনের স্ত্রী, যিনি রিক্সা চালিয়ে স্ত্রীর লেখাপড়ার খরচ মিটিয়েছেন। এ জন্য মাথা উঁচু করেই চলেন।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলা নশিপুর ঠিকাদার পাড়ার ফেরদৌস ম-লের লেখাপড়ার ইচ্ছে থাকলের কিশোর বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয়। প্রাথমিক পেরিয়ে যাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই রিক্সার হ্যান্ডেল ধরতে হয় সংসারের প্রয়োজনে। পাশের ধুনট উপজেলার নাংলু গ্রামের সীমানুর খাতুন যখন স্বামীর ঘরে আসেন তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। তখনো ফেরদৌস রিক্সা চালান। বিয়ে হয়েছিল পারিবারিকভাবে। তাই এ নিয়ে তার খেদ ছিল না।
স্বামীর বাড়িতে এসে তার ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া। মুখ ফুটে স্বামীকে বলেও ছিলেন তা। না করেননি ফেরদৌস। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন লেখাপড়ায় যতদূর যেতে চায় তার খরচ মেটাতে কোনো কার্পণ্য করবেন না, সে যত কষ্টই হোক। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে স্বামীর উৎসাহ পেয়ে সীমানুরের চোখে তখন আনন্দের জলধারা। তারপর আর পিছে তাকাননি। এরই মাঝে দুজনের সংসারে নতুন দুটি মুখ এসে তাদের আনন্দ ও দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়।
সীমানুর বিএ পাস করেন সেখানকার কলেজ থেকে। এর পর মাস্টার্স সম্পন্ন করতে ভর্তি হন বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী সরকারি আযিযুল হক কলেজে। গত বছর ইসলামের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে মাস্টার্স পাস করে উচ্চ শিক্ষার আশা পূরণ করেছেন সীমানুর। এখন একটি ভালো চাকরি সীমানুর-ফেরদৌস দম্পতির দরিদ্র সংসারে নতুন আলো এনে দিতে পারে। সীমানুর জানালেন, তিনি যখন প্রাইভেট পড়তেন তখন নিজে রিক্সায় স্ত্রীকে পৌঁছে দিয়ে আসতেন ফেরদৌস।
সীমানুর আরও জানালেন, বগুড়া সরকারি আযিযুল হক কলেজে পড়ার সময় বাড়ি থেকে স্বামীর রিক্সাতেই কলেজ যেতেন। বন্ধুরা যখন জেনেছেন তার স্বামী একজন রিক্সাওয়ালা, সে নিয়ে তার একুটুও লজ্জা ছিল না, এখনো নেই। বন্ধুদের সামনে রিক্সাচালক স্বামীর পরিশ্রমের কথা বলতেন গর্বের সঙ্গে। তার লেখাপড়ার জন্য স্বামী ফেরদৌসের নিদারুণ পরিশ্রম আর ত্যাগের বিষয়টি সীমানুরের সামনে অনুপ্রেরণা ও অহংকারী করে তোলে। কারণ স্ত্রীর লেখাপড়া চালাতে গিয়ে তাকে বেশি সময় ধরে রিক্সা চালাতে হয়েছে।
সকাল থেকে রিক্সা চালাতে হয় বলে আগে সপ্তাহের বেশিরভাগ সময় শহরে রিক্সার গ্যারেজে রাত কাটাতে হয়েছে। এখন বাড়িতে সেলাইয়ের কাজে স্বল্পভাষী ফেরদৌস সময় পেলেই স্ত্রীকে সহায়তা করেন। সীমানুর এলাকার শিশুদের লেখাপড়া শেখান। একটি বেসরকারি সংস্থা এ জন্য তাকে মাসে এক হাজার টাকা দেয়। আর শিশুদের অভিভাবকরা মাসে ৩০ টাকা করে দেন। এলাকার শিশুদের কাউকে বললেই ম্যাডম বলে সীমানুরের বাড়ি চিনিয়ে দেবে।
এভাবে দু’জনের চেষ্টায় চলে যাচ্ছে সংসার। এই দম্পত্তির এক ছেলে ও এক মেয়ে। এলাকায় কোনো রিক্সাচালকের স্ত্রী মাস্টার্স সম্পন্ন করেননি। এ জন্য ফেরদৌস দম্পত্তি নিজস্ব পরিচয় সৃষ্টি হয়েছে। গাবতলীর নশিপুর বাজার এলাকায় রিক্সাচালক ফেরদৌস ম-লের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে যে কেউ দেখিয়ে দেবে। অনেকেই জানেন তাদের সংগ্রামী জীবনের কথা। সীমানুর জানালেন, এখন তার লক্ষ্য একটি ভালো চাকরি। এতদিন স্বামী তাকে কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। নিজে রিক্সা চালিয়ে তাকে কলেজে প্রতিদিন পৌঁছে দিতেন। এমন একজন মানুষকে তিনি আর কষ্টে রাখতে চান না।
রিক্সাচালক স্বামীকে অন্তত একটু বিশ্রাম ও হাড়ভাঙা খাটুনি থেকে মুক্ত করে শান্তিতে রাখতে চান। শিক্ষক নিবন্ধন, সমাজসেবা বিভাগসহ কয়েকটিতে চাকরির আবেদন করেছেন। ফেরদৌসকে নিয়ে রিক্সায় মাঝে মাঝেই চাকরির খবর পাওয়া ও আবেদন করা যায় এমন কম্পিউটারের দোকানগুলোতে খোঁজ নিতে শহরে আসেন। সুযোগ বুঝে আবেদনও করেন। আর শহরে রিক্সা চালাতে চালাতে ফেরদৌসও স্ত্রীর জন্য চাকরির সন্ধান করতে থাকেন। সুযোগ পেলেই যাত্রীদের জিজ্ঞাসা করেন এটি কোন দপ্তর, এখানে চাকরির জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে কি না?
এভাবে জিজ্ঞাসা ও রিক্সার প্যাডেল চালিয়ে স্ত্রীর জন্য একটি স্বপ্নের চাকরির কথা ভাবতে ভাবতেই ফেরদৌস চলে যান এক গন্তব্য থেকে আরেক গন্তব্যে। আর বাড়িতে বসে স্ত্রী অস্বস্তিতে থাকেন শহরের রাস্তায় রাস্তায় স্বামীর কষ্টের কথা ভেবে। তারও স্বপ্ন কবে তিনি একটি চাকরি করে স্বামীর কাঁধ থেকে সংসারের বোঝা নামিয়ে একটু স্বস্তি দিতে পারবেন। এভাবেই চলে যায় ফেরদৌস-সীমানুর দম্পতির সংগ্রামী জীবনের পথ। জনকণ্ঠ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১১/০১/২০২৪