রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি কেনা চূড়ান্ত পর্যায়ে
নিউজ ডেস্ক।।
বাংলাদেশের কাছে করোনাভাইরাসের টিকা স্পুটনিক-ভি বিক্রির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার আই ইগ্নটভ। গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনের সাথে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। রাশিয়া থেকে ৫০ লাখ ডোজ স্পুটনিক-ভি টিকা কিনতে আগ্রহী বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন না পেলেও স্পুটনিক-ভি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ৯৭ দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারে বলে রাশিয়া দাবি করছে। বিষয়টি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ডব্লিউএইচওতে প্রতিষ্ঠিত হলে স্পুটনিক-ভি কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্যকর টিকা হিসেবে প্রমাণিত হবে। বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর জরুরি ব্যবহারের জন্য স্পুটনিক-ভি টিকার অনুমোদন দিয়েছে।
এ দিকে যুক্তরাষ্ট্র সঙ্কটে থাকা বাংলাদেশকে জরুরি ভিত্তিতে করোনার টিকা দিতে রাজি হয়েছে বলে গতকাল জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন। তবে তা কবে, কী পরিমাণে আসবে তা তিনি জানাতে পারেননি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চিকিৎসা সরঞ্জামের একটি চালান আজ দেশে আসবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ চলতি মাসেই রাশিয়ার সাথে টিকা কেনার চুক্তি সই করে জুলাই থেকে স্পুটনিক-ভির প্রথম চালান পেতে চায়। এই টিকা কেনা এবং যৌথ উৎপাদনে যাওয়ার পূর্বশর্ত হিসাবে রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অপ্রকাশযোগ্য চুক্তি সই করেছে। অর্থাৎ এই টিকার প্রস্তুত প্রণালীসহ অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত তৃতীয় কোনো পক্ষকে জানানো যাবে না।
এ দিকে চীন থেকে দেড় কোটি ডোজ সিনোফার্মের টিকা কেনার ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতার আপাত অবসান হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে চীনের সাথে আলোচনা হয়েছে। এটা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে চীনের ক্ষোভ প্রশমিত করতে হয়েছে। দেড় কোটি ডোজ সিনোফার্মের টিকা আমরা ১০ ডলারেই সরবরাহ পাবো বলে আশা করছি। তবে ভবিষ্যতে এই টিকার দাম কত হবে- তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
গত ২৭ মে মন্ত্রিসভা কমিটি সিনোফার্মের দেড় কোটি টিকা প্রতিটি ১০ ডলারে কেনার প্রস্তাবে সম্মত হয়। এর পরপরই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. শাহিদা আখতার প্রেস ব্রিফিংয়ে সিনোফার্মের টিকা কি পরিমাণে কত দামে কেনা হচ্ছে তা প্রকাশ করেন। অপ্রকাশযোগ্য চুক্তির শর্ত ভেঙ্গে টিকার দাম প্রকাশ করে দেয়ায় বিষয়টি নিয়ে তদন্তের জন্য ড. শাহিদা আখতারকে মন্ত্রিপরিষদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে।
চীনপ্রতি ডোজ টিকা শ্রীলঙ্কার কাছে ১৪ ডলার ও ইন্দোনেশিয়ার কাছে ১৭ ডলারে বিক্রি করছে। বাংলাদেশে সিনোফার্মের বিক্রয়মূল্য গণমাধ্যমে জানার পর এসব দেশ চীনকে কম দামে টিকা বিক্রি করতে চাপ দিচ্ছে। চীন এ নিয়ে বাংলাদেশের ওপর বেশ বিরক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডাইরেক্টর জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসেস (ডিজিএইচএস) ঢাকায় চীনা দূতাবাসকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন চীনের রাষ্ট্রদূতের সাথে কথা বলে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন।
ডব্লিউএইচওর অনুমোদন পাওয়া সিনোফার্ম টিকা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ৭৯ শতাংশ সুরক্ষা দিতে পারে। এই টিকা ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের দুই ডোজ করে দিতে হয়। চীনের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া সিনোফার্মের প্রথম চালানের পাঁচ লাখ টিকা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত চীনা নাগরিক, সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজের শিক্ষার্থী, নার্সিং শিক্ষার্থী এবং মেডিক্যাল টেকনোলজি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে দেয়া হচ্ছে। চীন সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে দেয়া সিনোফার্মের দ্বিতীয় চালানোর ছয় লাখ টিকা সরবরাহের জন্য আগামী ১৩ জুন প্রস্তুত থাকবে বলে জানিয়েছে দেশটির দূতাবাস। উপহারের এসব টিকা আগের মতোই বাংলাদেশ নিজস্ব বিমানে চীন থেকে নিয়ে আসবে।
এ দিকে গতকাল চীনের তৈরি অপর টিকা সিনোভ্যাক জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। সিনোভ্যাক ডব্লিউএইচওর অনুমোদন পাওয়া চীনের তৈরি দ্বিতীয় টিকা। বাংলাদেশে সিনোভ্যাক টিকার পরিবেশক হিসেবে কাজ করবে ইনসেপ্টা ভ্যাকসিন লিমিটেড। সিনোভ্যাকের পক্ষে ইনসেপ্টা এ টিকার অনুমোদনের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে আবেদন করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি খাতে করোনা টিকা পাওয়ার পথ উন্মুক্ত হলো।
বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফাইজার, মডার্না ও জনসন অ্যান্ড জনসনের করোনা টিকা আনতে চাইছে। একই সাথে তারা যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর সাথে যৌথ উৎপাদনেও যেতে আগ্রহী। তবে বেসরকারি খাতের কাছে টিকা বিক্রি বা যৌথ উৎপাদনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে জি টু জি (সরকার থেকে সরকার) কাঠামো চুক্তি চেয়েছে মার্কিন ওষুধ কোম্পানিগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানিগুলোর এ সংক্রান্ত মতামত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার দিক থেকে ফাইজার ও মডার্নার টিকার সুখ্যাতি রয়েছে।
ফাইজারের টিকা ৯৫ শতাংশ এবং মডার্না টিকা ৯৪ শতাংশ সুরক্ষা দেয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফাইজারের টিকা ১২ বছরের বেশি যেকোনো বয়সী মানুষকে দেয়ার বিষয়টি অনুমোদন করেছে। অর্থাৎ এই টিকা কিশোর থেকে বৃদ্ধ- যেকোনো বয়সের মানুষকেই দেয়া যাবে। অন্য দিকে জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা ৭৮ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারে। তবে জনসন অ্যান্ড জনসন টিকার সুবিধা হলো- এটা সিঙ্গেল ডোজ। অর্থাৎ এই টিকার একটি ডোজই যথেষ্ঠ। ফাইজার ও মডার্না দুই ডোজের টিকা।
গত রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে ৫০ লাখ স্পুটনিক-ভি টিকা দ্রুত কিনতে চায়। অনুমোদন পেলে দেশের কয়েকটি কোম্পানি রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে এই টিকা উৎপাদন করতে পারবে। গতকাল রাশিয়ার বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি রাশিয়া থেকে দ্রুত টিকা আমদানির জন্য রাষ্ট্রদূতের সহযোগিতা কামনা করেন। এ ছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজের গতি এবং মানে সন্তোষ প্রকাশ করেন ড. মোমেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাশিয়া বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাশিয়ার সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। ড. মোমেন বাংলাদেশের উন্নয়নে রাশিয়ার অবদান এবং বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগিতার জন্য রাশিয়া সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে টিকা আসার সুখবর : সঙ্কটে থাকা বাংলাদেশকে নিজেদের মজুদ থেকে করোনাভাইরাসের টিকা দিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার রাজি হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল এই তথ্য জানিয়েছেন। তবে কবে নাগাদ, কী পরিমাণ টিকা আসবে, তা স্পষ্ট করেননি তিনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে মোমেন বলেন, ‘ভালো সংবাদ হচ্ছে আমেরিকা ভ্যাকসিন দেবে আমাদেরকে। সঠিক পরিমাণ এখনো জানি না।’
ভারত রফতানির নিষেধাজ্ঞা না তোলায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থাকা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৬ কোটি অতিরিক্ত ডোজ থেকে কিছু টিকা পাঠাতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিল বাংলাদেশ। চলমান কূটনৈতিক ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের তৎপরতায় এই কাজে সফল হওয়ার খবর দিলেন মোমেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কোভিডের মধ্যে সাকসেস হওয়ার পরে আরেক ঝামেলা! লোক বেশ কম মরছে বলে তারা আমাদের পাত্তা দেয় না। আমরা বেশ কষ্ট করে পাত্তায় আসছি।’
সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ না জানালেও ‘খুব শিগগির’ ওই টিকা পাওয়ার আশা প্রকাশ করে মোমেন বলেন, ‘আশা করছি খুব শিগগিরই, আমাদের তারা ভ্যাকসিন দেবে। কোভ্যাক্স থেকেও পাবো।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের তো দরকার অনেক। অন্য দেশের মতো না যে, ২০ হাজার, এক লাখ হলে হয়ে যাবে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চিকিৎসাসরঞ্জামের একটি চালান সোমবার বাংলাদেশে আসবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
সিনোভ্যাকের স্থানীয় এজেন্ট ইনসেপ্টা
নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, চীনের সিনোভ্যাক লাইফ সায়েন্সের উদ্ভাবিত ‘করোনাভেক’ বাংলাদেশে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। এই টিকার স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনুমতি পেয়েছে ইনসেপ্টা ভ্যাকসিন লিমিটেড। গতকাল ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো: মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। সিনোভেক চীনের একটি বেসরকারি কোম্পানি।
মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) গত ১ জুন চীনের এই টিকাটি জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। ইনসেপ্টা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কাছে সিনোভ্যাকের এই টিকাটি অনুমোদনের জন্য আবেদন করে। ওষুধ প্রশাসন গত ৩ জুন ইনসেপ্টার আবেদন মঞ্জুর করে।
উল্লেখ্য, সিনোভ্যাকের টিকা নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাস দিয়ে বানানো হয়েছে। গবেষকরা বানরের কিডনি সেলে (কোষে) প্রচুর পরিমাণে ভাইরাস তৈরি করে বিটা প্রোপিওলেকটোন নামক একটি রাসায়নিকের মধ্যে ভাইরাসগুলোকে ডুবিয়ে দেন। এতে করে জীবন্ত ভাইরাসগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
এগুলো বংশ বৃদ্ধি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তা সত্ত্বেও ভাইরাসগুলোর স্পাইক প্রোটিন অক্ষত রয়ে যায়। এই অবস্থায় গবেষকরা নিষ্ক্রিয় ভাইরাসগুলোকে বিটা প্রোপিওলেকটোন থেকে তুলে এনে অ্যালুমিনিয়াম-ভিত্তিক যৌগ ‘অ্যাডজুভেন্ট’-এ মিশিয়ে ফেলেন। এই অ্যাডজুভেন্ট ইমিউন সিস্টেমকে উত্তেজিত করে ভাইরাসের (টিকার) কার্যকারিতা বাড়াতে।
ঠিক একই পদ্ধতিতে ১৯৫০ সালে পোলিও ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা আবিষ্কার করা হয়। এই নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাস যখন শরীরে প্রবেশ করানো হয় তখন আসল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিরুদ্ধে শরীরের ইমিউন সিস্টেম কাজ করতে শুরু করে। বি সেল অ্যান্টিবডি তৈরি করতে থাকে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট অনুসারে, চীনের সিনোভেকের টিকা ব্রাজিল ও তুরস্কে ট্রায়াল হয়েছে। ব্রাজিলের পরীক্ষায় সিনোভেকের টিকা লক্ষণযুক্ত ও লক্ষণ ছাড়া রোগীকে ৫০.৬৫ শতাংশ সুরক্ষা দেয়। কিন্তু তুরস্কের ট্রায়ালে দেখা গেছে, লক্ষণযুক্ত রোগীদের ৯১.২৫ শতাংশ সুরক্ষা দেয়। চীন ছাড়াও এক ডজনের চেয়ে বেশি দেশে জরুরি ব্যবহারের জন্য সিনোভেকের টিকা অনুমোদন পেয়েছে