রমজান: পণ্যমূল্যে বাজারে আগুন
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
আজ থেকে শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। হু হু করে মূল্য বাড়তে থাকা নিত্যপণ্যের বাজারে তাই রীতিমতো আগুন লেগে গেছে। সেই আগুনের আঁচে পুড়ছে ভোক্তার পকেট। স্বল্প আয়ের মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্তদেরও বেসামাল দশা। এ থেকে কবে মিলবে পরিত্রাণ- এ প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।
রোজা সামনে রেখে সদাইপাতি কিনতে বাজারে এসেছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী মো. এনামুল হক। দুই লিটার তেল, এক কেজি চিনি আর যৎসামান্য মসুর ডাল, ছোলা, বেসন ও খেজুর কিনতেই উধাও হয়ে গেছে হাজার টাকা। বাজারদর নিয়ে কথা শুরু হতেই ক্ষোভ উগড়ে দিলেন তিনি। রাজধানীর কদমতলী এলাকার বাসিন্দা এনামুল বলেন, এখনো মসলাপাতি, মুড়ি, মাংস, ডিম কেনা হয়নি। পেঁয়াজ, মরিচ, লেবুসহ আরও কত কি বাকি! কিন্তু পকেট হয়ে গেছে গড়ের মাঠ!
আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বলেন, ইফতারের সময় যে একটু শরবত মুখে দেব, তারও জো নেই! ১০০ গ্রাম ইসবগুলের ভুষি ৩৫০ টাকা, চিনির কেজি ১১৫ টাকা। এই যদি হয় বাজারের অবস্থা, রোজায় কি খেয়ে থাকব। জিনিসপত্রের দামে আমাদের দম বন্ধ দশা। এ থেকে পরিত্রাণ মিলবে কবে।
বাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পেরে উঠছেন না গৃহকর্মী মোসাম্মত নাসিমা আক্তারও। গৃহস্থের বাসার কাজ করে সামান্য যে আয় তা দিয়ে বাসা ভাড়া
দেওয়ার পর অবশিষ্ট থাকে না কিছুই। এমন পরিস্থিতিতে রোজায় ডাল-ভাত, তরিতরকারি খেয়েও চলতে পারবেন কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাসিমা বলেন, ‘মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়েছি। নতুন করে ডিমও খাই না। ডাল-ভাত, শাকপাতা আর আলুর তরকারি খাইতেও তো তেল, নুন, মসলা লাগে। সেগুলোর দাম তো আকাশছোঁয়া। রোজার ৩০টা দিন পোলাপাইনগুলারে নিয়া কীভাবে পার করমু জানি না। খাওয়া কমাইয়াও কুলাইতে পারতাছি না। বাইচা থাকাই কঠিন হইয়া গেছে।’
প্রতিবছর রমজান মাসকে ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গোটা বাজার। কিন্তু এবার রোজার অনেক আগে থেকেই একে একে বেড়েছে সব জিনিসপত্রের দাম। ভোজ্যতেল, চিনি, আটা, মাছ-মাংস, দুধ, ডিমের বাজার আগে থেকেই আগুন। চাল, ডালের খরচও কুলিয়ে উঠতে পারছে না বেশির ভাগ ভোক্তা। রোজার মাসে চাহিদা থাকলেও ছোলা, খেজুর, মুড়ির খরচও পড়ছে অনেকের কাঁধে। গরিবের অ্যাংকর ডালের দামটাও এ বছর রোজায় বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। সামান্য লবণটাও গত রোজার চেয়ে ৮ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে কিনে খেতে হচ্ছে।
রোজায় দ্রব্যমূল্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিতের লক্ষ্যে অসাধু চক্রদের ঠেকাতে টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। রোজার মাসে ‘কালোবাজারি, মজুদদাররা’ যাতে বাজারে নিত্যপণ্যের সংকট সৃষ্টি করতে না পরে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বানও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পণ্যের সংকট সৃষ্টির চেষ্টাকে ‘গর্হিত কাজ’ বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। অপরদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ সরকারি একাধিক সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে বরাবরের মতো ‘দাম বাড়বে না’ বলে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে রোজায় বাজার স্বস্তির পর্যায়ে রাখতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইও বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছে। অথচ বাজারে এসবের কোনো প্রভাব পড়ছে না। রোজার আগেই প্রয়োজনীয় সব পণ্যে দাম কেবল বাড়ছেই।
ব্যবসায়ীদের দাবি, রোজা উপলক্ষে নিত্যপণ্যের চাহিদ অনেক হারে বাড়লেও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটের কারণে আমদানি এবার কম এবং বিশ্ববাজারের কারণে দামও বাড়তি রয়েছে। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারিতে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা বেড়েছে, যা সন্তোষজনক। সুতরাং রোজায় পণ্যের সংকট হবে না। কিন্তু ভোক্তারা এর সুফল পাবেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, রোজার মাসে দেশে ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ মে. টন পেঁয়াজ, আড়াই থেকে ৩ লাখ মে. টন সয়াবিন তেল, ৩ লাখ মে. টন অপরিশোধিত চিনি, ৮০ হাজার মে. টন ছোলা, ৫০ হাজার মে. টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। যেখানে সয়াবিন ও চিনিতে শুল্ক সুবিধা দিয়েছে সরকার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেছেন, দেশে ভোগ্যপণ্যের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। চিনির কিছুটা সংকট ছিল। সে সংকট সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে স্থানীয় প্রশাসন বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি পরিবারের মধ্যে সুলভমূল্যে পণ্য সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া অনিয়ম বন্ধে সব ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে গত বছর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ-পরবর্তী এপ্রিল-জুন সময়ে বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়লেও গত বছর ডিসেম্বর থেকে তা কমেছে বলে তথ্য উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে। অথচ দেশের বাজারে এর কোনো ছাপ পড়েনি। বরং চিনি ও আটার মতো বিভিন্ন পণ্যের দাম উল্টো দফায় দফায় বেড়েছে।
বাজারচিত্র ও সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে এক বছরে জিনিসপত্রের কী পরিমাণে বেড়েছে তা যাচাই করলে দেখা যায়, গত বছরের চেয়ে এবার প্রতি কেজি মোটা চালে ১ থেকে ২ টাকা, খোলা আটায় ২০ টাকা, চিনিতে ৪০ টাকা, ছোলায় ২০ টাকা, অ্যাংকর ডালে ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেশি খরচ করতে হচ্ছে। প্রতিলিটার সয়াবিনের বোতল প্রতি এবার রোজায় ২০ টাকা বেশি খরচ করতে হবে। এ ছাড়া খেজুরের কেজিতে ১০০ টাকা পর্যন্ত খরচ বেড়েছে।
অপরদিকে মসলার বাজারে এবার পেঁয়াজ বিপদমুক্ত থাকলেও রসুনের কেজিতে এ বছর ৩০ থেকে ৬০ টাকা, দেশি আদায় ৮০ থেকে ১১০ টাকা, বিদেশি হলুদে ৫০ থেকে ৬০ টাকা, জিরায় ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা এবং শুকনা মরিচে ১৫০ থেকে ২১০ টাকা পর্যন্ত বেশি খরচ করতে হচ্ছে।
মাংসের বাজারের আগুন দামে হাত পুরছে মধ্যবিত্তের। আতঙ্কে মাংসের বাজারে পা রাখছেন না নিম্নবিত্তরা। সাধ্যের ব্রয়লার মুরগির কেজিও এখন ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, গত বছরের চেয়ে যা ১০৫ টাকা পর্যন্ত বেশি। ডিমের হালিও ৫০ টাকায় ঠেকেছে।
রোজার মাসে সাধারণত যেসব পণ্যের প্রয়োজন হয় এর মধ্যে রয়েছে মোটা চাল, খোলা আটা, বোতলজাত সয়াবিন, চিনি, ছোলা, খেজুর, অ্যাংকর, মসুর, রসুন, দেশি আদা, বিদেশি হলুদ, শুকনা মরিচ, জিরা, ব্রয়লার মুরগি, গরু, রুই মাছ, ডিম, গুড়া দুধ ও লবণ।
এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার যাচাই করলে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে এই ১৯টি পণ্যের দাম গড়ে ৩৭.৮৩ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার রোজায় এসব পণ্যের পেছনে ভোক্তাকে প্রায় ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত বেশি খরচ করতে হচ্ছে।
যেখানে রমজানের আগেই সরকারি সংস্থা ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন জানিয়েছে, গত রমজানের তুলনায় এবার পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ বেশি বাড়বে। কিন্তু বাজারচিত্র বলছে রোজা শুরুর আগেই ভোক্তার খরচ প্রায় ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, সংকটের ফলে পণ্যমূল্য এবার কিছুটা বাড়তি থাকবে বলে আশঙ্কা করা হলেও বাস্তবে বাজারে তা অতিরিক্ত বেড়েছে। বরাবরের মতো ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা করার প্রবণতাই এর পেছনে দায়ী বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে রমজান উপলক্ষে পণ্যের দাম কমে।
আর আমাদের এখানে কেবল বাড়ে। আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতির চেয়ে ব্যবসায়ীদের লোভস্ফীতি বেশি ভয়ানক। অনেকেই নৈতিক ব্যবসা করছেন না। মুরগির বাজার দেখলেই বোঝা যায় যে, বাজার সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেছে। নইলে ব্রয়লারের দাম লাফিয়ে ২৫০ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, বাজারে মোবাইল কোর্ট চালিয়ে সমাধান মিলবে না। বাজার ব্যবস্থায় ফাঁক এবং মনিটরিংয়ে বড় ত্রুটি রয়েছে। চাহিদা ও সরবরাহে নিবিড় নজরদারি থাকতে হবে।
সরবরাহ স্বাভাবিকের কাছাকাছি থাকলেও অতিরিক্ত দাম বাড়তে পারে না। পাশাপাশি বাজারে কারসাজিকারীদের কেবল চিহ্নিত করলেই হবে না, শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
বাজার হাতে গোনা কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার না থাকায় অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসন।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা নেই। হাতে গোনা কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান অনেক আমদানিপণ্যের বাজার দখল করে আছে। নানা জটিলতায় নতুন ব্যবসায়ী সহজে বাজারে প্রবেশ করতে পারেন না।
এক ট্রেড লাইসেন্স করতেই তাকে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। নতুন কেউ ব্যবসায় এলেও বড়দের কারসাজিতে বাজারে টিকে থাকতে পাড়েন না বেশিদিন। প্রতিযোগিতামূলক বাজার না থাকলে শুল্ক সুবিধা কেন, কোনো সুবিধারই সুফল ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাবে না।
এ জন্য যথাযথ মনিটরিংয়ের তাগিদ দিয়ে তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে মনিটরিং মানে খুচরা বা পাইকারি ব্যবসায়ীকে গিয়ে জরিমানা করা হয়। এটাকে আসলে মনিটরিং বলে না। এতে হাতে গোনা কয়েকজন খুচরা কিংবা পাইকারি ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এভাবে হবে না। আমদানিতে খরচ হলো কত, সরবরাহে বিক্রি হচ্ছে কত টাকায়, মজুদ থাকলে কী পরিমাণ রয়েছে, পণ্যটিতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার রয়েছে কিনা- এসব মনিটরিং করতে হবে।