যে মহাদেশে কোন দেশ নেই
নামে মহাদেশ হলেও সেখানে কোনো দেশ নেই। স্থায়ীভাবে বসবাসের কোনো সুনির্দিষ্ট স্থান নেই একটি মহাদেশে। মানুষ তো দূরের কথা, এমনকি কোনো পিপড়া কিংবা সরীসৃপও এখানে বসতি গড়তে পারেনি! পুরো মহাদেশ জুড়ে আছে কেবল প্রকাণ্ড আকারের বরফ আর পানি। একটু হলেও আন্দাজ করতে পারছেন কোন সে মহাদেশ? উপরে বর্ণিত সবগুলো বৈশিষ্টে ভরা মহাদেশটির নাম অ্যান্টার্কটিকা। রহস্য আর আশ্চর্যজনক সব বৈশিষ্ট সম্পন্ন মহাদেশটি সম্পর্কে থাকছে এই আয়োজনে।
অ্যান্টার্কটিকা পৃথিবীর সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত। আয়তনে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম মহাদেশ। এর আয়তন ১ কোটি ৪০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। অষ্ট্রিলয়া মহাদেশের তুলনায় অ্যান্টার্কটিকা প্রায় দ্বিগুণ হলেও এখানে কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করেনা। এখানকার আবহাওয়া মনুষ্যকূলের অনুকূলে না থাকা সবচেয়ে বড় কারণ। অ্যান্টার্কটিকার ৯৮ শতাংশ এলাকা বরফে ঢাকা। আর এই বরফের পুরত্ব সর্বনিম্ন এক কিলোমিটার!
গোটা পৃথিবীর মোট বরফের ৯০ শতাংশ জমে আছে অ্যান্টার্কটিকায়। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে এক মাত্র শতাংশ জায়গা আছে যেখানে বরফ নেই। মজার ব্যাপার হলো গত দুই মিলিয়ন বছরে এই এলাকাতে কোন বৃষ্টিপাত হয়নি। চির বরফের এই রাজ্যকে বরফের মরুভূমি হিসেবেও ডাকা হয়। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২০০ মি.মি হওয়ায় অ্যান্টার্কটিকাকে শীতল মরুভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা মাইনাস ৮৯ ডিগ্রি পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছে।
পৃথিবীর মোট বিশুদ্ধ পানির ৭০ শতাংশ পানির যোগান রয়েছে আন্টার্কটিকায়। পুরো আন্টার্কটিকায় প্রায় ৩০০ টি হ্রদের দেখা মিলেছে। পৃথিবীপৃষ্টের উষ্ণতার কারণে হ্রদের পানি বরফ হয়না। ফলে পান যোগ্য পানির দেখা মিলে অ্যান্টার্কটিকায়। টলমলে আর বিশুদ্ধ পানির সবচেয়ে বড় যোগান একসাথে দেখতে চাইলে অ্যান্টার্কটিকার বিকল্প নেই। অন্যদিকে অ্যান্টার্কটিকা পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতম ও শুষ্কতম জায়গা। এই মহাদেশের ড্রাই ভ্যালি পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। অ্যান্টার্কটিকায় বায়ুপ্রবাহের বেগও অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় অনেক বেশি।
দুই ঋতু বিশিষ্ট অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে এক ঋতুর সাথে আরেক ঋতুর রাত দিন তফাত। গ্রীষ্মকালে সূর্য কখনো-ই পুরোপুরি অস্ত যায়না। দিগন্ত রেখা বরাবর চারদিকে ঘুরতে থাকে। অন্যদিকে শীতকালের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন।
শীতকালে টানা চার মাস এখানে সূর্যের দেখা মিলেনা। অন্ধকারচ্ছন্ন হয়ে থাকে বরফের রাজ্য। এসময় তাপমাত্রা গিয়ে নেমে আসে ৮০ ডিগ্রির নীচে!প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য এখানে স্থায়ী কোনো আবাসস্থল না থাকলেও গবেষণার কাজে প্রায় সবসময়ই বিজ্ঞানীরা আসা যাওয়া করেন। প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে গড়ে প্রায় ৪ হাজার বিজ্ঞানী গবেষণা করতে এখানে আসেন। শীতকালের চ্যালেঞ্জ নিতে মাত্র ১ হাজার বিজ্ঞানী অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থান করেন।
মজার ব্যাপার হলো, মনুষ্যকূলের প্রতিকূলে থাকা এই মহাদেশকে অনেক দেশ নিজেদের দাবি করেছে। অ্যান্টার্কটিকায় কোনো স্থায়ী বাসিন্দা না থাকায় ১৯০৮ সালে ব্রিটেন অ্যান্টার্কটিকার মালিকানা দাবি করে। ব্রিটেনের দেখাদেখিতে কালক্রমে ফ্রান্স, অষ্ট্রেলিয়া এবং ১৯৪৩ সালে আর্জেন্টিনা অ্যান্টার্কটিকার মালিকানা দাবি করে বসে।১৯৫৯ সালে ১২ টি দেশের মধ্যে অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
কোনো ধরনের সামরিক কর্মকাণ্ড এবং খনিজ সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়। কেবল বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে সহায়তা এবং অ্যান্টার্কটিকার ইকোজনকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। ১২ টি দেশের মধ্যে স্বাক্ষর হওয়া চুক্তিতে বর্তমানে ৪৬টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। চুক্তির মধ্যে এই ভূমিকে কেউ নিজেদের দাবি করতে পারবে না থাকলেও ১৯৭৭ সালে অ্যান্টার্কটিকাকে নিজেদের দাবি করতে আর্জেন্টিনা এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে। আর্জেন্টিনার পক্ষ থেকে গর্ভবতী এক মহিলাকে অ্যান্টার্কটিকায় পাঠানো হয় এবং সফলভাবে সন্তান প্রসব করেন!
এমিলিও মার্কোস পালমা নামের ছেলেসন্তান অ্যান্টার্কটিকায় জন্ম নেয়া প্রথম সন্তান!বরফের রাজ্য অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে যাওয়া নিয়ে শঙ্কা আছে। ২০১৩ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের দেওয়া তথ্যমতে, পৃথিবীর সব বরফ গলে গেলে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে দাঁড়াবে ২১৬ ফুট। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে পৃথিবীর হিমঘর খ্যাত অ্যান্টার্কটিকার বরফ দ্রুত গলতে শুরু করেছে। পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার বরফ এখনকার মতো গলতে থাকলে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, গুয়াংজু, ওসাকা ও মুম্বাইয়ের মতো বড় শহর পানির নীচে চলে যাবে। মানুষের সতর্ক পদক্ষেপ-ই পারবে অ্যান্টার্কটিকাকে তথা পুরো পৃথিবীকে বাঁচাতে!