যেখানে ঠেকেছি সেখান থেকে শুরু: কর্মমুখী শিক্ষা
রফিক উল্লাহঃ আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ছয় বছর বয়সের সকল শিশু বাধ্যতামূলকভাবে স্কুলে যাবে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের ধনী এবং দরিদ্র মানুষের স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত সকল শিশুদের মধ্যে শতকরা সত্তর ভাগ বা তার কিছু বেশি শিশু স্কুলে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। প্রচলিত শিক্ষা কার্যক্রম অনুসারে পঞ্চম শ্রেণিতে সমাপনি পরীক্ষায় ড্রপআউট, অষ্টম শ্রেণিতে জেএসসি পরীক্ষায় ড্রপআউট, নবম শ্রেণিতে টেস্ট পরীক্ষায় ড্রপআউট, এসএসসি পরীক্ষায় ড্রপআউট, কলেজে ভর্তির সময় ড্রপআউট, এইচএসসির প্রি–টেস্টে ড্রপআউট, সর্বশেষ এইচএসসিতে ড্রপআউট।
তাছাড়া প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে এইচএসসি পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণিতে কোনোনা কোনভাবে ড্রপআউট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এতে করে দেখা যায় সত্তর–আশি জন শিশু স্কুলে ভর্তি হলে এইচএসসি পর্যন্ত শতকরা সত্তর জন ড্রপআউট অর্থাৎ ঝরে পড়ে। চলমান শিক্ষা পদ্ধতিতে এ বৃহদাকার ঝরে পড়া ছাত্র–ছাত্রীদের জন্য বিকল্প পর্যাপ্ত কোন পথ বা ব্যবস্থা নেই বললে চলে। যা রয়েছে তা অপ্রতুল। কতজন কিভাবে ঝরে পড়ে বা কোন পথে যাচ্ছে, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের ডাটা ব্যাজও সংরক্ষণ করা হয় না। দেশে স্বল্প সংখ্যক কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব। অনেক কারিগরি প্রতিষ্ঠানে এমপিও নেই, নেই প্রতিষ্ঠনের ভাল অবকাঠামো, নেই উন্নত গবেষণাগার। এক কথায় কারিগরি শিক্ষার ভাল কোন পরিবেশ নেই। যে ক’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাল শিক্ষা ব্যবস্থা আছে তাতে ছাত্র–ছাত্রী সংকুলান হয়না এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা ছাত্র–ছাত্রীদের বিদেশে কাজ করার মত পর্যাপ্ত যোগ্যতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। যেহেতু ঝরে পড়া ছাত্র–ছাত্রীর পরিমাণ অর্ধেকেরও বেশি সে কারণে আলাদাভাবে তাদের পড়াতে হলে বর্তমানে দেশে যত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার সম–পরিমাণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নতুন করে নির্মাণ করতে হবে, এটি সম্ভব নয়। এভাবে বছরের পর বছর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ঝরে পড়া ছাত্র–ছাত্রীদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে এবং অগ্রসর ছাত্র–ছাত্রীদের তুলনায় অনগ্রসর ছাত্র–ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে পরিবেশের ভারসাম্য না থাকার সম্ভাবনা বেশি। যে কোনো মূল্যে ঝরে পড়া ছাত্র–ছাত্রীদের কর্মমুখী শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনতে পারলে দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে ওঠবে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে রক্ষা পাবে বিশাল জনগোষ্ঠি। ঝরে পড়া ছাত্র–ছাত্রীদের নিয়ে এখনই কার্যক্রম শুরু করা অপরিহার্য। দেশে এবং দেশের বাইরে শিক্ষিত, দক্ষ জনশক্তির চাহিদা প্রচুর, কিন্তু সে দক্ষ জনশক্তি বর্তমানে আমাদের নেই। যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষিত, দক্ষ জনশক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গড়ে তুলে দেশ ও দেশের বাইরে শ্রম বাজারে আমাদের অবস্থান করে নেয়া প্রয়োজন।
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে কর্মমুখী শিক্ষার কোনো বিরোধ নেই। বরং এটি প্রচলিত শিক্ষার সাথে সম্পূরক ব্যবস্থা। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ধাপে ধাপে উচ্চ শ্রেণিতে এবং সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করছে অগ্রসর ছাত্র–ছাত্রীরা। সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জনকারী ব্যক্তিও বেকার আছে অনেকে। একইভাবে যে সব ছেলে মেয়েরা ড্রপ আউট হয়েছে এবং কোন দিন স্কুলে না গিয়ে কিশোর থেকে যুবকে পরিণত হয়েছে তাদের নাম শুধু বেকারত্বের খাতায় নয়, বোঝার খাতায়ও লেখা হয়েছে। শিক্ষিত, অশিক্ষত বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে দেশে এবং দেশের বাইরে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা পূরণের জন্য যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা, সুন্দর অবকাঠামো সম্বলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এবং প্রতিষ্ঠানরে জনবলকে সহজে কাজে লাগিয়ে একই স্কুল কলেজে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর, অমনযোগী ছাত্র–ছাত্রীদের সনাক্ত করে এবং তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করে, বেকারত্বের অভিশাপ ও সন্ত্রাসমুক্ত একটি জাতি গঠনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মমুখী শিক্ষা চালু করে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাড়া পাওয়া গিয়েছে। ছাত্র–ছাত্রীরা পড়া–লেখার পাশাপাশি যেকোন একটি কমসংস্থানমুখী কাজ শিখতে খুবই আগ্রহী। স্কুলপড়ুয়া কোন ছাত্র–ছাত্রী বর্তমান সমাজে বেকার থাকতে ইচ্ছুক নয়। তারা তাদের ভবিষ্যৎ ভাল করে বুঝার চেষ্টা করছে। গ্রাম ভিত্তিক কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয় ও মাদ্রাসাগুলোতে কর্মমুখী শিক্ষা চালু করতে পারলে একটি স্বনির্ভর ও দক্ষ জনশক্তি, অপরাধ মুক্ত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। জনসচেতনতা ও শিক্ষার মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক কর্মমুখী শিক্ষা চালু করতে পারলে স্কুলে যাওয়ার সকল উপযুক্ত শিশু স্বেচ্ছায় স্কুলে আসবে। কর্মমুখী শিক্ষা বাস্তবায়ন করলে নিম্নলিখিত ফলাফল পাওয়া যাবে। ১। দেশে কোন লোক বেকার থাকবে না, ২। কোনো লোক অশিক্ষিত থাকবে না, ৩। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দ্রুত হ্রাস পাবে, ৪। পরিশেষে একটি অপরাধমুক্ত সুন্দর সমাজ পাবো।
লেখক : প্রাবন্ধিক
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৪/০১/২০২৪
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়