যেকারণে ‘১’ মৌলিক সংখ্যা নয়
গণিতের প্রধান উপকরণ সংখ্যা। এই সংখ্যার উৎপত্তি কবে এবং কোথায় এর উত্তর আজ আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে সংখ্যার ধারণা যে মানুষের অতি প্রাচীনকাল থেকেই ছিল সে ব্যাপারে সকলেই এক মত। সম্ভবত মানুষ যখন থেকে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবিনে অভ্যস্ত হতে শুরু করে তখন থেকেই সংখ্যার ধারণার শুরু। শূন্য আবিষ্কারের পর সংখ্যার জগৎ সীমাহীন হয়ে পড়ে।
এর শুরু কোথায় আর শেষই বা কোথায় তা আমাদের অজানা। তাই সর্ব বৃহৎ বলে এখন যেমন আর কোনো সংখ্যা নেই তেমন সর্ব নিম্ন সংখ্যা বলেও কোনো সংখ্যা নেই। এই সীমাহীন সংখ্যার জগতে এমন কিছু সংখ্যা আছে যাদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে চিহ্নিত করা হয়েছে।
যেমন ১, ২, ৩, ৪ …. ইত্যাদি সংখ্যাগুলিকে বলা হয় স্বাভাবিক সংখ্যা বা প্রাকৃত সংখ্যা। গণনার কাজে ব্যবহৃত হয় বলে এদের গণক সংখ্যাও বলা হয়। ১ ব্যতীত বাকি সব সংখ্যাই ১-কে পর পর যোগ করে (১+১=২, ১+১+১=৩ ইত্যাদি) পাওয়া যায় বলে গ্রিক গণিতজ্ঞ পীথাগোরাস (খ্রিঃ পূঃ ৫৮৪ — ৪৯৩) ১-কে ‘কারণ’ বা ‘হেতু’ সংখ্যা ও অন্য সংখ্যাগুলির উৎপত্তিস্থল বলে চিহ্নিত করেছিলেন।
স্বাভাবিক সংখ্যার আরেকটি প্রাচীন ভাগ হল মৌলিক সংখ্যা ও যৌগিক সংখ্যা। আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক গণিতবিদ ইউক্লিড মৌলিক সংখ্যার কথা প্রথম বলেন। মৌলিক সংখ্যা হল এমন স্বাভাবিক সংখ্যা যার কেবলমাত্র দুটি পৃথক উৎপাদক আছে- ১ এবং ঐ সংখ্যাটি নিজে।
তাই বলা যায়, যে সকল সংখ্যা ১ ও সেই সংখ্যা ব্যতীত আর কোনো সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য নয় তাদের বলা হয় মৌলিক সংখ্যা। সংখ্যার জগতে প্রথম মৌলিক সংখ্যা হল ‘২’। এখন প্রশ্ন হল, ১ কেন মৌলিক সংখ্যা নয়? এর উত্তরে বলা যায়, ১ হচ্ছে সংখ্যা গঠনের একক। ১-এর সঙ্গে ১ ক্রমান্বয়ে যোগ করে আমরা যে কোনো স্বাভাবিক পূর্ণ সংখ্যা গঠন করতে পারি। প্রত্যেকটি ক্রমিক সংখ্যা ১ করেই বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ ১-কে সংখ্যা গঠনের মৌলিক একক বলা যেতে পারে।
এরপরেও ১-কে মৌলিক সংখ্যার স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। এর কারণ, ১ যদি মৌলিক সংখ্যা হয় তাহলে পাটীগণিতের কিছু মৌলিক স্বীকার্যের অস্তিত্ব থাকে না। তাই মৌলিক সংখ্যার সংজ্ঞা নির্ধারনের সময় সু-কৌশলে ১-কে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মৌলিক সংখ্যার সংজ্ঞা হলঃ “যেসব স্বাভাবিক পূর্ণ সংখ্যা এক-এর চেয়ে বড় এবং ১ ও সেই সংখ্যা ছাড়া আর কোনো সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য নয় তাদের বলা হয় মৌলিক সংখ্যা। পারফেক্ট সংখ্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা করারা সময় ইউক্লিডের মৌলিক সংখ্যার ধারণাটি আসে।
সংজ্ঞা অনুসারে বলা যায়, মৌলিক সংখ্যার দুটি উৎপাদক থাকবে, একটি ১ এবং অপরটি ঐ সংখ্যাটি নিজে। দুইয়ের অধিক উৎপাদক থাকলে যেমন সংখ্যাটি মৌলিক সংখ্যা হবে না তেমন দুটির কম উৎপাদক থাকলেও সংখ্যাটি মৌলিক সংখ্যা হবে না। ১-এর একটি মাত্র উৎপাদক, ১ নিজেই। এখন ১ সংখ্যাটিকে যদি মৌলিক ধরে নেওয়া হয় তাহলে মৌলিক সংখ্যা সংক্রান্ত সংজ্ঞাটির কোনো ভিত্তি থাকে না। অতএব নিয়মানুসারে ১ মৌলিক সংখ্যা হতে পারে না।
একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাকঃ
আমরা জানি, ৭ একটি মৌলিক সংখ্যা। কারণ ৭-এর কেবলমাত্র দুটি গুণণীয়ক আছে। একটি ১ এবং অপরটি ৭ অর্থাৎ সংখ্যাটি নিজে ((৭ = ১ × ৭)। এখানে লক্ষণীয় যে উৎপাদক দুটি পৃথক।
এখন ১-এর ক্ষেত্রে কী আসছে দেখা যাকঃ
১ = ১ × ১
এখানে দুটি গুণণীয়কই এক, পৃথক নয়। তাই ১-এর উৎপাদক একটিই ধরা হয়।
আবার ফিরে যাই ৭-এর ক্ষেত্রে-
৭ = ১ × ৭
কিংবা
৭ = ১ × ১ × ৭
অথবা
৭ = ১ × ১ × ১ × ৭
১-এর ক্ষেত্রেও অনুরূপ দৃষ্ট হয়। যেমন,
১ = ১ × ১ × ১ × ১….
এখানে দেখা যাচ্ছে, ৭ ও ১-এর উৎপাদক অনির্দিষ্ট। অর্থাৎ সমীকরণকে ইচ্ছেমতো বাড়ানো যায়।
তাই, ১ সংখ্যাটিকে যদি মৌলিক সংখ্যা ধরে নেওয়া হয় তাহলে গণিতের মৌলিক স্বীকার্যগুলির কোনো ভিত্তি থাকে না। অর্থাৎ কোনো পূর্ণ সংখ্যাকে কেবল একভাবেই মৌলিক উৎপাদকের গুণফল হিসেবে প্রকাশ করা যাচ্ছে না, বরং অসীম সংখ্যকভাবে প্রকাশ করা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে মৌলিক সংখ্যাকে যে অন্যান্য সংখ্যার সুনির্দিষ্ট ভিত্তিমূল ধরা হয় তা মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
১ থেকে ১০০ এর মধ্যে ২৫টি (২, ৩, ৫, ৭, ১১, ১৩, ১৭, ১৯, ২৩, ২৯, ৩১, ৩৭, ৪১, ৪৩, ৪৭, ৫৩, ৫৯, ৬১, ৬৭, ৭১, ৭৩, ৭৯, ৮৩, ৮৯, ৯৭) মৌলিক সংখ্যা আছে। আর ১০১ থেকে ২০০ এর মাঝে আছে ২১টি মৌলিক সংখ্যা (১০১, ১০৩, ১০৭, ১০৯, ১১৩, ১২৭, ১৩১, ১৩৭, ১৩৯, ১৪৯, ১৫১, ১৫৭, ১৬৩, ১৬৭, ১৭৩, ১৭৯, ১৮১, ১৯১, ১৯৩, ১৯৭ এবং ১৯৯)। এখানে দেখা যাচ্ছে ১ থেকে ১০০ এর মধ্যে যে ক’টি মৌলিক সংখ্যা আছে তার চেয়ে কম সংখ্যক মৌলিক সংখ্যা আছে ১০১ থেকে ২০০ এর মধ্যে। এখ
ন একটা প্রশ্ন হতে পারে, সীমাহীন সংখ্যা জগতে মৌলিক সংখ্যা কি নির্দিষ্ট? এর উত্তর গণিতবিদদের জানা নেই। কারণ মৌলিক সংখ্যা নির্ণয়ে কোনো সাধারণ নিয়ম এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গণিতজ্ঞরা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এ ব্যাপারে যাঁর নাম সর্বপ্রথম করতে হয় তিনি ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক ইরাটস্থেনেস (২৭৬ খ্রিস্টপূর্ব — ১৯৪ খ্রিস্টপূর্ব)। তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতির নাম ‘চালনী পদ্ধতি’।
এই পদ্ধতিতে সংখ্যাগুলোকে ছকে সাজিয়ে তার পর এক এক করে প্রথম সংখ্যাটিকে মৌলিক সংখ্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তার সব গুণিতকগুলো কেটে দিতে হবে। উল্লেখ্য যে যদি ছকের কোন সর্বোচ্চ সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া না থাকে তবে অ্যালগরিদমটি অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে। শুধু তাই নয়, পদ্ধতিটি অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। এই পধতিতে সর্ববৃহৎ মৌলিক সংখ্যা নির্ণয় অত্যন্ত দুরূহ কাজ।
‘স্বাভাবিক সংখ্যার’ সংখ্যা যদি খুব বেশি হয় তাহলে তার ভিতর থেকে বৃহত্তম মৌলিক সংখ্যাটি বের করা যতই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। হোক না কেন গণিতবিদরা কিন্তু হাল ছেড়ে দেন নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গণিতবিদ এ নিয়ে কাজ করেছেন। ১৯২৭ সালে ফকিন বার্গ যে বৃহত্তম মৌলিক সংখ্যাটির খোঁজ পান তার মান হল ২ ১২৭-১।
এই সংখ্যাটি ৩৯টি অঙ্ক দ্বারা গঠিত। ১৯৫২ সালে আর এম রবিনসন ২ ৫২১-১, ২ ৬০৭-১, ২ ১২৭৯-১, ২ ২২০৩-১ এবং ২ ২২৮১-১ এই পাঁচটি বড় মৌলিক সংখ্যার খোঁজ দেন। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা (১৯৬৩) তে যে বৃহত্তম মৌলিক সংখ্যাটির উল্লেখ আছে সেটি হল ২ ১১২১৩ -১। ১৯৮৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার গণিতবিদ জন ব্রাউন ও তাঁর সহযোগীরা যে বৃহৎ মৌলিক সংখ্যাটি আবিষ্কার করেন সেটা হল, ২ ২১৬১৯৮× ৩৯১৫৮১ — ১।
এর অঙ্ক সংখ্যা ৬৫০৮৭টি। আধুনিক সংখ্যাতত্ত্বের জনক ফার্মাট ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে মৌলিক সংখ্যা নির্ণয়ের একটি সূত্র দেন। এই সূত্রের সাহায্যে প্রাপ্ত মৌলিক সংখ্যাগুলিকে বলা হয় ফার্মাট সংখ্যা। যদিও তাঁর দেওয়া সূত্রটি ত্রুটি মুক্ত নয়। এর চার বছর পর অর্থাৎ ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী গণিতবিদ মার্টিন মার্সিনী মৌলিক সংখ্যা নির্ণয়ের একটি সূত্র দেন। এই সূত্রের সাহায্যে প্রাপ্ত মৌলিক সংখ্যাগুলিকে বলা হয় মার্সিনী সংখ্যা। তাঁর সূত্রটিও ত্রুটি মুক্ত নয়।
মৌলিক সংখ্যা নির্ণয়ে ফার্মাট এবং মার্সিনীর মতো অয়লারও একটি সূত্রের কথা বলেন। তাঁর দেওয়া সূত্রটি হল, n = 0, ১, ২, ৩, ৪…. ধরে n ২+ n + ৪১ থেকে প্রাপ্ত সংখ্যাগুলি মৌলিক সংখ্যা হবে। প্রথম দিকে মনে হয়েছিল যে অয়লার এর এই সূত্রটি এতদিনের একটি সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবে। কিন্তু বাধ সাধল n = ৪০ ধরে। অয়লারের সূত্রে n = ৪০ বসালে যে সংখ্যাটি পাওয়া যায় সেটা হল ১৬৮১ যা ৪১ দ্বারা বিভাজ্য। কাজেই অয়লারের সূত্রটিও অসম্পূর্ণ।
নতুন আবিষ্কৃত একটি মৌলিক সংখ্যা এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত মৌলিক সংখ্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। এতে মোট ২৩,২৪৯,৪২৫ টি অংক রয়েছে! এর নাম দেওয়া হয়েছে M77232917