যত লেখাপড়া তত খরচ!
শিক্ষাবার্তা ডেস্কঃ নতুন বছর, নতুন শ্রেণি, কারও আবার প্রথম ভর্তি। শিক্ষার্থীদের জন্য বছরের শুরুটা আনন্দেরই ছিল। নতুন বই হাতে পাওয়ার পর পরই চলে আসত নতুন খাতা, পেনসিল, কলমসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ। কিন্তু এ বছরের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। বছরের শুরুতে চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ কম, সেই সুযোগে দাম বেড়েছে সব ধরনের শিক্ষা উপকরণের। সবচেয়ে বেশি সমস্যা কাগজ ও খাতা নিয়ে। এর ফলে বিপাকে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত অভিভাবকরা। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় এমনিতেই হাঁসফাঁস অবস্থা অভিভাবকদের। তার ওপর শিক্ষা উপকরণের ব্যয় বৃদ্ধিতে ক্ষোভ ঝেড়েছেন অনেকেই। এ বছর শিক্ষা উপকরণ কেনাও কমিয়েছেন অনেক অভিভাবক। চাপে আছেন বিক্রেতারাও।
এ অবস্থায় অভিভাবকরা বলছেন, গতবছর খাতা-কলমসহ স্টেশনারি কিনতে যে টাকা ব্যয় হয়েছে, এবার লাগছে তার দেড়গুণ। খরচ এভাবে বাড়তে থাকলে অনেকের পক্ষেই সন্তানদের পড়াশোনা করানো সম্ভব হবে না।
নীলক্ষেতে কথা হয় একজন অভিভাবক মোদাচ্ছির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, তার বড় ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ে এবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে। নতুন বছরে ইচ্ছা ছিল একবারে কয়েক ডজন খাতা-কলম ও আনুষঙ্গিক শিক্ষা উপকরণ কিনে দেবেন সন্তানদের। কিন্তু অতিরিক্ত দামের কারণে সবকিছুই অর্ধেক করে কিনতে হয়েছে।
বেসরকারি এ চাকরিজীবী বলেন, দেশে কোনো কিছুর সংকট দেখা দিলেই সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হয়। শিক্ষা উপকরণেও তার প্রভাব পড়েছে হয়তো। সরকারও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মাঝখান দিয়ে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ।
রাজধানীর নীলক্ষেত ও ফার্মগেট ঘুরে দেখা যায়, বাচ্চাদের লেখার স্লেট, খোলা কাগজের দিস্তা, লেখার খাতা, ব্যবহারিক খাতা, পেনসিল, রং পেনসিল, কলম, মার্কার, স্কেল, জ্যামিতি বক্স, কলম-পেনসিল রাখার বক্স, ফাইল, ক্যালকুলেটর, পরীক্ষায় ব্যবহৃত ক্লিপবোর্ডসহ সব পণ্যের দাম বেড়েছে।
শিক্ষা উপকরণের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বড় আকারের খোলা কাগজের রিম ৫০০-৫৫০ টাকা এবং দিস্তা বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। মাস ছয়েক আগে এই কাগজের দিস্তা ২৫ টাকা ও রিম ৪০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছোট আকারের খোলা কাগজের রিম ৪৫০ টাকা ও দিস্তা বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। কয়েক মাস আগে এই কাগজের রিম ৩৫০ টাকা ও দিস্তা বিক্রি হয়েছে ২০ টাকায়। নিউজপ্রিন্টের ২০০-২৫০ টাকার রিম ৩০০ টাকা এবং ১৫ টাকার দিস্তা বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রায় সব উপকরণই আমদানি করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী। সেইসঙ্গে দেশে ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে। শুধু তাই নয়, ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার কারণে অনেক পণ্যই সময়মতো আমদানি করা যাচ্ছে না।
ফার্মগেটের বায়েজীদ লাইব্রেরি স্বত্বাধিকারী বায়েজীদ হোসেন বলেন, আমরা শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত করি না, কিনে আনতে হয়। শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে, তাই আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, দাম বাড়ায় আগের মতো বেশি পণ্য মজুত করতেও পারছি না। আবার অনেক অভিভাবক খাতা-কলম কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। ক্রেতাদের যে খামে শিক্ষা উপকরণ দেই, সেই পাতলা খাম আগে কিনতাম ৫০-৫৫ টাকায়, এখন কিনতে হচ্ছে ১১০ টাকায়। দাম বৃদ্ধির ফলে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত।
দেখা গেছে, ছয় মাস আগে ১২০ পৃষ্ঠার বাইন্ডিং খাতা ২৫ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তার দাম ৩৫-৪০ টাকা। ১৬০ পৃষ্ঠার ৪০ টাকা দামের খাতা ৫৫-৬০ টাকা, ২০০ পৃষ্ঠার ৫০ টাকা দামের খাতা ৬৫-৭০ টাকা এবং ৩০০ পৃষ্ঠার ৬০ টাকা দামের খাতা ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে, ১২০ পৃষ্ঠার ৪০ টাকার স্পাইরাল খাতা ৫০ টাকায়, ১৬০ পৃষ্ঠার ৫০ টাকা দামের খাতা ৬৫-৭০ টাকায়, ২০০ পৃষ্ঠার ৬৫ টাকা দামের খাতা ৮০-৮৫ টাকা এবং ৩০০ পৃষ্ঠার ৮০ টাকা দামের খাতা বিক্রি হচ্ছে ৯৫-১০০ টাকায়। বাচ্চাদের ২০ টাকা দামের ছোট খাতা বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকায়। ৪০ টাকার ড্রয়িং খাতা ৫০ টাকা এবং ৫০ টাকার খাতা বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকায়। বড় কাগজ মিলের তৈরি খাতার দাম আরও বেশি।
দাম বেড়েছে ব্যবহারিক খাতারও। ৫০ টাকার খাতা ৭০ টাকা এবং ৭০ টাকা খাতা বিক্রি হচ্ছে ৯০-১০০ টাকায়। ৩০ টাকার নোটবুকের দাম এখন ৪০ টাকা। ৩৫ টাকার কারেকশন কলম ৫০ টাকায়, ৮০ টাকার পাঞ্চ মেশিন ১০০ টাকায়, ৩০ টাকার মার্কার ৪৫-৫০ টাকায় এবং ৭০ টাকারটি বিক্রি হচ্ছে ৯০-১০০ টাকায়। ২০ টাকার সেমিনার ফাইল ৩০-৩৫ টাকা, ৫০ টাকার ফাইল ৭০-৭৫ টাকা, ডকুমেন্ট ক্যারিয়ার ১২০ টাকারটি ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৩০ টাকার পরীক্ষার ক্লিপ বোর্ড ৫০ টাকা এবং ৮০ টাকারটি ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
৫ টাকার কিছু কলম এরই মধ্যে ৬ টাকা হয়ে গেছে। খুচরা কলমে দাম খুব একটা না বাড়লেও ডজনপ্রতি বেড়েছে। ডজনে দাম বেড়েছে ইরেজার ও সার্পনারেও। ২০ টাকার স্কেল ৩০ টাকা, ৩০ টাকার স্কেল ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১০ টাকার পেনসিল হয়ে গেছে ১৫ টাকা, ডজনে দাম বেড়েছে ৩০-৪০ টাকা। ১২ পিসের ৮০ টাকা দামের প্যাকেট রং পেনসিল বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। কৌটার ১৪০ টাকারটি বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়। ৮০ টাকা দামের ১২ পিস মোম রং বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়, ২৮০ টাকা দামেরটি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৩৮০ টাকায়। ৩২০ টাকা দামের পেস্টাল রং বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ টাকায়। ৮০ টাকার জ্যামিতি বক্স ১২০ টাকা, ১২০ টাকারটি ১৫০ টাকা এবং ১৫০ টাকার জ্যামিতি বক্স ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২৫ টাকা দামের হাইলাইটার ৩৫-৪০ টাকা, ১৫ টাকা দামের আঠা ২০ টাকা, ৪০ টাকারটি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকায়। ৫০ টাকা দামের স্টাপলার ৭০-৮০ টাকা, ১০০ টাকারটি বিক্রি হচ্ছে ১৪০-৬০ টাকায়। ৪০ টাকা দামের পিন রিমুভার এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকায়।
৯৯১ ইএক্স সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটরের দাম ছিল ১৯০০-২০০০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০০০-৩২০০ টাকায়। ১৮৫০ টাকা দামের ইএস প্লাস ক্যালকুলেটর বিক্রি হচ্ছে ২২০০ টাকায়। এমএস ক্যালকুলেটরের দাম ছিল ১০০০-১২০০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪০০-১৫০০ টাকায়। ৩৮০ টাকা দামের সাধারণ ক্যালকুলেটর ৪৫০ টাকায়, ৩০০ টাকারটি ৪০০ টাকায়, ১০০ টাকারটি ১৫০ টাকায় এবং ১৫০ টাকারটি ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া গ্রাফ কাগজ, স্কুল ব্যাগ, কাঠের স্লেট, হোয়াইট বোর্ডসহ সব ধরনের শিক্ষা উপকরণের দামই বেড়েছে।
শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট করতে প্রয়োজন হয় অফসেট কাগজের। এই কাগজের দামও বেড়েছে। ৬৫ জিএসএম অফসেটের রিম ছিল ২৫০-২৮০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকায়; ৩৫০ টাকার ৭০ জিএসএম কাগজের রিম ৪০০ টাকা এবং ৩৭০ টাকার ৮০ জিএসএম কাগজের রিম বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়। রঙিন কাগজের রিম ছিল ৩০০-৩৫০ টাকা, এখন দাম ৪০০ টাকার বেশি। ২ টাকার ফটোকপি করতে হচ্ছে ৩ টাকায়। অ্যাসাইনমেন্টের কাজে ব্যবহৃত সাদা-কালো ও রঙিন প্রিন্টেও দাম বেড়েছে। এ ছাড়া ২০ টাকার স্পাইরাল করতে হচ্ছে ৩০ টাকায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ এহসান বলেন, টিউশনির টাকা না বাড়লেও শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে। পরীক্ষার জন্য শিট ফটোকপি করতে হয়, সেখানে খরচ বেড়েছে। বিভাগের বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট থাকে, সেজন্য কাগজ প্রিন্ট করে স্পাইরাল করতে হয়। কাগজের প্রিন্ট ও স্পাইরাল করা, দুটোরই দাম বেড়েছে। এ ছাড়া খাতা-কলমের দাম মনে হচ্ছে প্রতিদিনই বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক বছরের ব্যবধানে শিক্ষায় পারিবারিক ব্যয় যে হারে বেড়েছে তা বহন করা সীমিত আয়ের মানুষের জন্য কঠিন। দেশে শিক্ষা প্রসারে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিনা বেতনে পড়ানো হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে দেওয়া হচ্ছে উপবৃত্তি। তা সত্ত্বেও শিক্ষা উপকরণ কিনতে খরচ বাড়তে থাকলে অনেক অভিভাবকই সন্তানের শিক্ষা অব্যাহত রাখতে উৎসাহ হারাবেন। এতে স্কুলে ঝরে পড়ার হার বেড়ে যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বৈশ্বিক কারণে দেশেও বিভিন্ন সংকট দেখা দিয়েছে। শিক্ষাসামগ্রীর দাম বেড়েছে। এই সংকট নিরসনে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। শিক্ষা সহায়ক তহবিল থেকে দরিদ্রদের জন্য সহযোগিতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রে শিল্পপতি, বিত্তবান, জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে। এটা তাদের দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০১/১৮/২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়