ম্যানেজিং কমিটির বিষয়ে কিছু সুপারিশ
মোঃ আঃ বাতেন ফারুকী ।।
বাংলাদেশের বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ম্যানেজিং কমিটি ক্ষেত্রমতে গভার্নিং বডি গঠন ও তার কার্য পরিধি নির্ধারণকল্পে একটি বিধান রয়েছে। যা মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড,ঢাকা (মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি ) প্রবিধান মালা ২০০৯ নামে অভিহিত। ম্যানেজিং কমিটির বিষয়ে আজ ২২ আগস্ট সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তাই এ বিষয়ে কিছু মৌলিক ধারণা ও সুপারিশ পেশ করার ইচ্ছা পোষণ করছি। কিছুদিন আগে শিক্ষা মন্ত্রী ও উপমন্ত্রী মহোদয়দ্বয় ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে পরিস্কারভাবে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। এটা ভালো লক্ষণ।
পুরোপুরি বা ১৮০° ভিন্নমত থেকে একটি সুষম মত বেরিয়ে আসার সমূহ সম্ভাবনার সুযোগ আছে। পুরো শিক্ষক সমাজ তথা জাতি তাই আশা করে। সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অবশ্যই মনে রাখতে হবে ৯৫% মানুষের সন্তানরা উক্ত ম্যানজিং কমিটি ক্ষেত্রমতে গভার্নিং বডি পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে। একথা অনস্বীকার্য যে, এতদসংক্রান্ত বিদ্যমান প্রবিধান দ্বারা দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাগুলো খুব একটা ভালো চলছে না(ব্যতিক্রমও আছে)।
কোনো বিষয়ে আইন, বিধি, বিধান কিংবা প্রবিধান প্রণয়নের আগে চিন্তা করতে হবে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র বা বিষয়ের বিমূর্ত অবস্থা। উদাহরণস্বরূপ,গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক কিংবা একনায়কতান্ত্রিক রাস্ট্রের জন্য আইন ও বিধি-বিধান এক ধরনের হবে না। কাজেই শিক্ষার মান, পরিবেশ ও শিক্ষকের মান, মর্যাদা,নিরাপত্তা ইত্যাদি নিশ্চিত করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
প্রথমেই শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। ম্যানেজিং কমিটির সদস্যগণ শিক্ষিত হলেই শিক্ষার মান ও পরিবেশ উন্নত হবে কিংবা প্রতিষ্ঠান ভালো চলবে এর কোনো যৌক্তিকতা নেই।
আর শিক্ষা বলতে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই বুঝায় না। বরং অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্থাৎ প্রকৃতি, সমাজ ও বাস্তব জীবন থেকে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছে এমন মানুষের সংখ্যা সমাজে কম না। অবশ্য জীবন ও বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের সঠিক ধ্যান- ধারণা ও দর্শন নাও থাকতে পারে। এখানে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার তো খুব একটা সুযোগ নেই। কারণ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে ও সময় সময় পরিপত্র জারি করা হয়। সুতরাং শিক্ষাগত যোগ্যতা ম্যানেজিং কমিটি গঠনে সমস্যা হবে না। আর এখন গ্রামীণ সমাজেও শিক্ষিত (যেমন যোগ্যতার প্রশ্ন ওঠছে) লোকের তেমন অভাব হবে না।
এই তো ২৫/৩০ বছর আগেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনায় যারা আসতেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন অশিক্ষিত। কিন্তু তারা ছিলেন নিবেদিত প্রাণ,শিক্ষকমন্ডলীর সহায়ক শক্তি। সাদামাটা ও সোজা কথায় তারা ছিলেন শিক্ষা ও শিক্ষকের স্বার্থের পরিপূরক। এবং সবচেয়ে বড় লক্ষণীয় বিষয় ছিল তারা সবাই ছিলেন সমাজের নেতৃস্থানীয় লোক। একটি গোষ্ঠী বা গোত্রের প্রধান। সঙ্গত কারণেই তিনি তার গোষ্ঠী বা গোত্রের সুনাম বৃদ্ধিতে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। বর্তমানেও সমাজে এমন লোকের অভাব নেই। তাদেরকে কিভাবে প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়ানো যায় সে উপায় খুঁজতে হবে।
ম্যানেজিং কমিটিতে এমন লোকের দরকার যারা প্রতিষ্ঠানটিকে সামাজিকিকরণ করতে পারবেন। অর্থাৎ যারা সমাজের আচার- অনুষ্ঠানাদিতে সরব থাকেন, সমাজের বিবাদ -বিসংবাদ মিটমাট করতে সচেষ্ট হোন তাদেরই জড়ানোর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত থাকতে হবে ম্যানেজিং কমিটির প্রবিধানমালায়। আমরা, যারা শিক্ষার মাঠ পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা কাজের সাথে সরাসরি জড়িত, হাড়ে হাড়ে অনুধাবন করি সামািজকিকরণ কতটা কঠিন।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিদ্যমান প্রবিধানটি কমিটিকে সামাজিকিকরণের কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। তারা কেবল আর্থিক,প্রশাসনিক এনকি একাডেমিক কার্যকলাপেও হস্তক্ষেপ করছেন। যা কাম্য হওয়ার কথা না। আসলে কমিটির প্রধান কাজ হওয়া উচিত প্রতিষ্ঠানটিকে বিভিন্ন কোন্দল ও বিরোধ থেকে নিরাপদ রাখা। মোটকথা প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি হুমকির দিকগুলোর প্রতি বিশেষ নজর রাখা। আর্থিক দিকটিরও তত্ত্বাবধান করা। আর বাকি সব কাজে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও অন্যান্য শিক্ষকগণকে জোরালো সমর্থন দেয়া।
প্রবিধানটি সংশোধন বা পুনর্বিবেচনা করার আগে আরেকটি দিকে গুরুত্ব দেয়া দরকার। প্রধান শিক্ষকের প্রশাসনিক ও একাডেমিক হাত আরও শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি তার জবাবদিহিতাও বাড়াতে হবে এবং তা সরকারি প্রশাসনের আওতাভুক্ত হওয়া উচিত।
ম্যানেজিং কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা বাঞ্ছনীয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন কমিটি নির্বচন ছাড়া বিভিন্ন পদ্ধতিতে হচ্ছে। কাজেই শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে নির্বাচন ছাড়া কি কমিটি গঠন করা যায় না? কারণ মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন শিক্ষার পরিবেশকে অনেকটা ঘোলাটে করে তোলে। তাই যদি সম্ভবপর হয় তবে শিক্ষার স্বার্থে নির্বাচনের বিকল্প একটি পদ্ধতির মাধ্যমে কমিটি গঠনের সুপারিশ রাখছি।
সরকার বেসরকারি শিক্ষকগণকে এখন স্কেলের ১০০% বেতন দিচ্ছে, সামান্য হলেও বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা দিচ্ছে, সিকিভাগ উৎসব ভাতা এমনকি বিলম্বে হলেও বর্ধিত বেতন দিচ্ছে। এতসব দেওয়ার পরে আইনগত প্রশাসনিক তথা সার্বিক নিয়ন্ত্রণ নিতে বাধা কোথায় তা ভেবে পাচ্ছি না। বিভাগীয় জনবলের সমস্যা হলে আপাতত সরকারের নির্বাহী বিভাগের উপর কিছু দায়িত্ব অর্পন করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, যে কোনো কাজে বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়ার সুস্পষ্ট ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে না থাকলে কাজে গতিশীলতা ও দক্ষতা দু'য়েরই ঘাটতি থেকে যায়।
সভাপতি হিসেবে প্রথমে প্রতিষ্ঠাতা/ প্রতিষ্ঠাতাগণ কিংবা তার/তাদের কোনো যোগ্য উত্তরসূরি থাকলে তাকে বা তাদের মধ্যে একজনকে অথবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে এমন একজন সমাজপতি অথবা প্রশাসনের কাউকে মনোনয়নের ব্যবস্থা রাখা যেতে।
সদস্য মনোনয়নের ক্ষেত্রেও অনেক ভালো উপায় আছে যা আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যেতে পারে।
অর্থ বছর বলতে জুলাই থেকে জুন স্পষ্টিকরণ করা উচিত। বিদ্যমান অর্থ কমিটি তিনজন শিক্ষক সমন্বয়ে গঠিত হওয়ার স্পষ্টীকরণ থাকা উচিত। উক্ত কমিটি প্রতি তিন মাসে একবার সভায় মিলিত হবে। বৎসরে একবার সরকারিভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ক্ষেত্রবিশেষে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বা তার প্রতিনিধির মাধ্যমে অডিট কার্যক্রম সম্পাদন করা যেতে পারে। অথবা বিধিমালা প্রণয়ন করে স্থানীয় পর্যায়ে অডিট কমিটি গঠন করে অডিট কার্যক্রম চালানো যায়।
পরিশেষে বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণে একটি যুগোপযোগী পরিচালনা ব্যবস্থা প্রণয়নে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
লেখক-
প্রধান শিক্ষক
সৈয়দ হাবিবুল হক উচ্চ বিদ্যালয়
বৌলাই, কিশোরগঞ্জ।