মেধাশূন্য হচ্ছে বাংলাদেশ !
জাকারিয়া স্বপন :
একটি সমাজকে মেধা লালন করতে হয়। সে হলো চারাগাছের মতো। তার আলো বাতাস লাগে, চর্চা লাগে, পানি লাগে, যত্ন লাগে। আগাছা থেকে দূরে রাখতে হয় তাকে। আগাছা এসে তার ওপর ভর করলে, সেই চারাগাছ আর বেড়ে উঠতে পারে না। একটি সমাজব্যবস্থা যদি চারপাশ থেকে মেধাবীদের চেপে ধরে, তাহলে সে অসহায়। আইনস্টাইন কিংবা স্টিফেন হকিং-দের মতো মানুষের সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। যেই সমাজ সেই সাপোর্ট তৈরি করতে পারবে, তারা স্টিফেন হকিং পাবে। যারা পারবে না, তারা কখনই পারবে না
বাংলাদেশ থেকে হঠাৎ করেই অনেক শিল্পী আমেরিকায় চলে গেছেন সাম্প্রতিক সময়ে। বিষয়টি হয়তো অনেকেই জানেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ ক্যাটাগরিতে তাদের গ্রিনকার্ড দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের অনেক সেলিব্রিটি সেই সুযোগটা নিয়েছেন এবং অনেকেই ইতোমধ্যেই সেখানে বসবাস করতে শুরু করেছেন।
আমি এটার সমালোচনা করার জন্য লিখতে বসিনি। আমি শুধু বোঝার চেষ্টা করছি, তাদের ব্রেইনে নিশ্চয়ই এমন একটি লজিক এসেছে, যেই পয়েন্টে তারা মনে করেছেন, এই দেশে তাদের থাকাটা কিংবা তাদের বাচ্চাদের বেড়ে ওঠাটা কোনো অর্থ বহন করে না। এবং সেই যুক্তি নিশ্চয়ই এমন শক্তিশালী, যে কারণে তারা তাদের সমস্ত জীবনের শেকড়কে উপড়ে ফেলে এই বয়সে অন্য আরেকটি রাষ্ট্রে গিয়ে বসতি গড়ছেন।
[১] এবার আইফোনে চলবে অ্যানড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম! ≣ [১] জেলার ত্রাণ-স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রম মানা হচ্ছে কি না তদারকির দায়িত্বে সচিবরা: প্রধানমন্ত্রী ≣ আমরা কি চিকিৎসকদের সুরক্ষা দিতে পেরেছি?
আমি শুধু তাদের যুক্তিটুকু বোঝার চেষ্টা করছি। যৌবনে দেশ ছাড়া, আর প্রতিষ্ঠিত জীবনে দেশ ছাড়ার ভেতর অনেক পার্থক্য। যৌবনে সে জানে না, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে। কিন্তু যখন আপনি দাঁড়িয়ে গেছেন, আপনি বেশ শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত, সমাজে বিশেষ অবস্থান রয়েছে এবং কোটি কোটি মানুষ যাদের ভক্ত- তারা যখন ভিন দেশে দলবেঁধে চলে যাচ্ছেন, তখন সেটাকে কর্নারকেস বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। এটা দেশের ভেতরের কোনো সমস্যার আউটব্রাস্ট। কই কলকাতা থেকে এভাবে দলবেঁধে চলে গেছে শুনিনি তো। বলিউডের তারকারা দলবেঁধে দেশ ছেড়েছেন শুনেছেন আপনারা? নিশ্চয় কোথাও না কোথাও একটা ঝামেলা রয়েছে।
তারা কোনো না কোনোভাবে হতাশ। কিংবা এই সিস্টেমের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের সন্তানদের এই সিস্টেমের কাছে রেখে যেতে চাননি। তারা এই সিস্টেম থেকে শেষ বয়সে এসে সরে পড়েছেন। কিন্তু কেন?
দুই.
সম্প্রতি সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান তার কিছু এনালাইসিস সিরিজ আকারে প্রকাশ করছেন। আমি তার একটি এনালাইসিস হুবহু তুলে দিচ্ছি। আশা করছি, নাঈম ভাই রাগ করবেন না।
শিরোনাম: বাংলাদেশে সম্পাদকের মর্যাদা আশঙ্কাজনকভাবে কমছে।
[১] আমি এমনই সম্পাদক, যিনি সংবাদপত্রকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আয়-রোজগার করেন। এমন কেউ কেউ করেন, কিন্তু মর্যাদা হারায় সকলে।
[২] বাংলাদেশে সম্পাদক চাঁদাবাজি করি, অসম্মানের কালো ছায়া পড়ে সকল সম্পাদকের ওপর।
[৩] বাংলাদেশের আমি একজন সম্পাদক বিভিন্ন ব্যবসায়ীর পক্ষে তদবির করি মন্ত্রী, সচিবের কাছে। মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয় গোটা সম্পাদক সমাজের।
[৪] বাংলাদেশে আমি সম্পাদক নিজে এবং আমার সাংবাদিকদের দিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করে অর্থ উপার্জন করি। সম্পাদক হিসেবে আমাদের সকলের মাথা হেঁট হয়ে যায়।
[৫] আমার মতো কিছু সম্পাদক/সাংবাদিক মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের চরিত্র হননে লিপ্ত হন, ভুক্তভোগীর কাছে অপরাধী হন নির্বিচারে সব সম্পাদক/সাংবাদিক।
[৬] বাংলাদেশে আমার মতো এমন সম্পাদকও আছেন যিনি এবং যার সাংবাদিকরা ইংরেজিতেও এক ঘণ্টা বলতে পারবেন না, লিখতেও পারবেন না এক পৃষ্ঠার ইংরেজি, কিন্তু তারা জাতীয় ইংরেজি দৈনিক প্রকাশ করেন এবং সরকারের মিডিয়া লিস্টে উচ্চ স্থান পেয়ে যান। গোটা সংবাদপত্রশিল্পের জন্যই এটা লজ্জাজনক।
[৭] টেলিভিশন কিংবা সংবাদপত্রে আমি এবং আমার মতোই সম্পাদক, এই সাংবাদিকতার পরিচয় দিয়ে বিদেশি দূতাবাস, দেশের মন্ত্রী কিংবা সচিবের ঘরে প্রবেশ করে সাংবাদিকতা বা সংবাদপত্র নিয়ে কোনো আলোচনায় বা আবদার জানাই না। তোষামোদি আর গাল-গল্পের ফাঁকে নিজের ব্যক্তিগত বা বেনামী বাণিজ্য বা অন্যের ব্যবসা আদায়ের জন্য তদবির করেন। এভাবে সম্পাদকের সম্মান থাকে কী?
[৮] সম্মানের জন্য দামি বাড়ি, গাড়ি, অফিস পাইক-পেয়াদা প্রয়োজন হয় না। অনেকের জানাশোনা যোগাযোগ, অনেকের খাতির, অনেকের আনুগত্যকে সম্মান বলে না। অনৈতিক সমর্থন সম্মান পরিপন্থী। আবার অনেকের অপছন্দ হওয়া মানেও অসম্মান নয়।
(এই প্রতিবেদনের অনুলেখক: ফাহমিদা তিশা)
একজন সিনিয়র সাংবাদিক যখন এই এনালাইসিস দেন, এর অর্থ হলো সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকতা শেষ। পিরিয়ড। বিগত ৫০ বছরে এটা ভালো হয়নি, উল্টো শেষ হয়েছে। আগে যে মানের এবং মেধাবীরা এই ক্ষেত্রে আসতেন, এখন ঠিক উল্টো। মেধাবীরা এই ক্ষেত্র ছেড়ে গেছেন, কিংবা দেশে আর মেধা নেই, যারা এই ক্ষেত্রটির হাল ধরতে পারতেন। কিংবা হাল ধরার অবস্থাটুকুও নেই।
এই কথাটুকু যারা মানতে পারবে না, তারা ওপরের ওই গোষ্ঠীর। ধন্যবাদ নাঈম ভাই, এভাবে বিষয়টা তুলে আনার জন্য। আমাদের যেহেতু আত্মসম্মান লোপ পেয়েছে, আপনার এবং আমার এই লেখা খুব সামান্যই কারো গায়ে লাগবে। একজন সাংবাদিকের যখন মর্যাদাটুকু শেষ, তখন তার আসলে সবই শেষ!
তিন.
বাংলাদেশে সাংবাদিকরা যেভাবে মর্যাদা হারিয়েছেন, তার চেয়েও বেশি হারিয়েছেন শিক্ষকরা। মর্যাদা যে একটা বিষয়, এটাই যখন কারো ভেতর কাজ করে না, তার পক্ষে তো সেটা বোঝা অসম্ভব। যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার পক্ষে কি বোঝা সম্ভব আত্মসম্মান কী জিনিস?
বিগত ৩০ বছরে শিক্ষকরা তাদের জায়গাটা হারিয়েছেন। জি, মাত্র ৩০ বছরে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের যে শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীরা নিহত হয়েছিলেন, তাদের কাছাকাছি মাত্রার শিক্ষক এখন তৈরি হচ্ছে বলে মনে হয় না।
বিগত ৩০ বছরে শিক্ষক নিয়োগে যে প্রক্রিয়া পালন করা হয়েছে, তাতে মেধাবীরা শিক্ষক হতে পারেনি। আর মেধাবী যারা কোনোরকমে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে হতে পেরেছেন, তারা কয়েক বছরের মধ্যেই বিদেশে চলে গেছেন। তাদের খুব কম সংখ্যক দেশে ফিরেছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য দেখলেই সেটা অনুমান করা যাবে। আর যারা মেধাবী কিন্তু ধান্ধাবাজি করে শিক্ষক হতে পারেননি, তারাও দেশ ছেড়েছেন আরো আগেই।
আর বাকি মেধাবী শিক্ষকরা চলে গেছেন সাইডলাইনে। তাদের কোনো ভূমিকা রাষ্ট্রের ভেতর থাকে না। ফলে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারছে না। এবং সেটা হওয়ার সম্ভাবনাও আপাতত নেই। আমাদের আশপাশের দেশগুলো তাদের শিক্ষার মানকে যেই মাত্রায় নিয়ে গেছে, আমরা তার থেকে যোজন যোজন দূরে। আমাদের হাতে গোনা কয়েকজন ছাত্রছাত্রী আন্তর্জাতিক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন পেলেই আমরা মনে করছি, আহ অনেক তো করে ফেলেছি। এমআইটি কিংবা হার্ভার্ডে ভর্তির সুযোগ পেলে পত্রিকায় নিউজ হয়, এমন দেশ আফ্রিকায়ও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে।
আমাদের মাত্রা আমরা এমন জায়গাতেই নামিয়ে নিয়ে এসেছি। আমরা ভাবতে পারি না, আমাদের দেশে সিঙ্গাপুরের মতো ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে, আমাদের কোরিয়ার মতো কাইস্ট থাকবে, কিংবা অন্তত থাইল্যান্ডের মতো এআইটি থাকবে, নয়তো ভারতের মতো আইআইটি থাকবে। এগুলো আমাদের চিন্তার বাইরে। এটা সম্ভব হয়েছে কেবল একটি কারণেই। ক্রমাগত মেধাশূন্যতা। আগামী ৩০ বছরে বাংলাদেশে একজন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন বোস, কুদরাত-ই-খুদা, জামাল নজরুল ইসলামের মতো বিদ্যান মানুষ এ দেশে তৈরি হবে না।
চার.
মেধাবীদের আরেকটি বড় অংশ কাজ করে ক্রিয়েটিভ জগতে- শিল্প, সাহিত্য, কবিতা, গান, সিনেমা, ভাস্কর্য ইত্যাদি। আচ্ছা, বাংলাদেশে কি ভালো সাহিত্য হচ্ছে? লেখক তৈরি হচ্ছে? গান হচ্ছে? গায়ক হচ্ছে? অভিনয়শিল্পী তৈরি হচ্ছে? সিনেমা হচ্ছে? ভাস্কর্য হচ্ছে?
সবগুলোর উত্তর হলো, একটি বড় আকারের ‘না’। এ বিগ নো!
সম্প্রতি খালেদ মহিউদ্দীন এই বিষয়ে বেশ সুন্দর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি যা বলছিলেন তার সারাংশ করলে দাঁড়ায়, বাংলাদেশে শিল্পী তৈরি হচ্ছে না। অনেকেই বলেন, নায়করাজ রাজ্জাক মারা গিয়ে দেশে বিশাল একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে। আইয়ুব বাচ্চু মারা গিয়ে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এন্ড্রু কিশোর না থাকা সংগীতের ক্ষেত্রে বিশাল ক্ষতি। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করছেন না, আইয়ুব বাচ্চু শেষ গানটি কত বছর আগে গেয়েছেন? এন্ড্রু কিশোর শেষ গানটি কবে গেয়েছেন? নায়ক রাজ্জাকের শেষ সিনেমাটি কবের? একজন শিল্পী সেদিনই মারা গেছেন যেদিন থেকে তিনি তার সৃষ্টিকে বন্ধ করে দিয়েছেন। সেই হিসাবে আরো ২০ বছর আগেই আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যু হয়েছিল। নতুন করে কোনো ক্ষতি হয়নি।
খুবই কঠিন নিষ্ঠুর কিন্তু সত্য বচন। আমাদের গানের মৃত্যু হয়েছে আরো ২০ বছর আগেই। আমাদের সিনেমার মৃত্যুও তাই। ভাস্কর্য বাংলাদেশে কখনই ভালো ছিল না। লেখকদের মৃত্যুও হয়েছে এই শতকেই।
যেটা ভালো হচ্ছে না, সেটাকে ইনিয়ে বিনিয়ে ভালো বলাটাও আমাদের সমাজে বেশ চলছে। কারণ, আমরা ভালোটা তৈরি করতে পারছি না। ওটা করার জন্য যে মেধা এবং ফোকাস দরকার, সেটা আমাদের নেই। এটা মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হয়। তাই অকপটে স্বীকারও করতে পারি না। তখন ‘কেন হয়নি’, তার এক শ একটা যুক্তি নিয়ে হাজির হই। আগে স্বীকার করি যে, বর্তমানের আমরা পারি না। তারপর কথা হবে, কেন পারি না।
অখাদ্য সব জিনিসপত্র দেখতে হচ্ছে প্রতিদিন। নর্দমার পচা খাবারকেও বলছি, বেশ বেশ!
পাঁচ.
মেধাযুক্ত যে বিষয়গুলো একটি সমাজে থাকে, তার সবকিছুতেই বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে নেতিবাচক দিকে। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে শঠতা, মিথ্যা আর চাতুরতা। তাহলে কী হবে এই দেশটির?
দেশ মেধাশূন্য হলেও একটি জায়গায় বাংলাদেশ ভালো করছে। আর সেটা হলো অর্থনীতি। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ভালো করছে এবং ইতিবাচক- সেটা কিন্তু সত্যি। আগামী ২০ বছর বাংলাদেশ অর্থনীতিতে ভালো করবে। ২০ বছর কেন বললাম, সেটা আগামী লেখায় বিশ্লেষণ করে দেব।
একটি সমাজকে মেধা লালন করতে হয়। সে হলো চারাগাছের মতো। তার আলো বাতাস লাগে, চর্চা লাগে, পানি লাগে, যত্ন লাগে। আগাছা থেকে দূরে রাখতে হয় তাকে। আগাছা এসে তার ওপর ভর করলে, সেই চারাগাছ আর বেড়ে উঠতে পারে না। একটি সমাজব্যবস্থা যদি চারপাশ থেকে মেধাবীদের চেপে ধরে, তাহলে সে অসহায়। আইনস্টাইন কিংবা স্টিফেন হকিং-দের মতো মানুষের সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। যেই সমাজ সেই সাপোর্ট তৈরি করতে পারবে, তারা স্টিফেন হকিং পাবে। যারা পারবে না, তারা কখনই পারবে না। দুই দলের মাইন্ডসেট ভিন্ন!
আগামী ২০ বছরে আর এগুলো হবে না। তাই লেখালেখি, গান, সিনেমা, শিক্ষকতা, গবেষণা, সাংবাদিকতা- সবকিছুর গুণগত মান আবার ধীরে ধীরে আসতে শুরু করবে ২০ বছর পর থেকে। তত দিন এভাবেই চলবে বাংলাদেশ!