মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা
এই বিশাল পৃথিবীতে একমাত্র মানুষের জন্য প্রয়োজন পরিচিতি, রয়েছে দেশ, পাসপোর্ট, বিদেশভ্রমণে রয়েছে ভিসা। বিশ্বায়নের সুবাদে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ভ্রমণে ভিসা পেতে তেমন কোনো অসুবিধা নেই। বিশ্বায়নের যুগে সব কর্মকাণ্ড চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের আওতায়। এমন বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় প্রতিটি দেশ চায় তার দেশকে সবার ওপরে রাখতে। প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য উত্পাদন ব্যয় হ্রাস বা সমান খরচে অধিক উত্পাদনের নিশ্চয়তা। সব উৎপাদন ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু মানবসম্পদ। এবং সে কারণেই মানসম্মত মানবসম্পদের চাহিদা বিশ্বময়। যোগ্য ব্যক্তির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মানবসম্পদ রপ্তানির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন অবস্থায় অনেক দেশ উচ্চতর জ্ঞান, বিজ্ঞান, কারিগরি শিক্ষায় তাদের দেশের মানুষকে শিক্ষিত করে মানবসম্পদ রপ্তানি করছে। আর এমন অবস্থায় করোনার মতো মহামারির কারণে ব্যাহত হচ্ছে মানবসম্পদ সৃষ্টির সব কার্যক্রম। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
মানবসম্পদ রপ্তানির সূচনায় বাংলাদেশ অংশ নিতে না পারলেও বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি মানুষ বিদেশে কর্মরত। উল্লেখ্য, তাদের কষ্টার্জিত উপার্জনের জন্যই বর্তমান বৈশ্বিক মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার অবস্থান চাহিদার তুলনায় সন্তোষজনক। তবে আমাদের সন্তানদের শিক্ষার মান যদি আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি রাখা নিশ্চিত করা যেত, তাহলে একদিকে যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ আরো বেশি থাকতে পারত, অন্যদিকে আমাদের সন্তানদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নত হওয়ার নিশ্চয়তায় পারিবারিক জীবন আরামদায়ক হতে পারত। কারণ আমাদের প্রবাসীদের অধিকাংশই বিদেশে শ্রমিকের চাকরিতে কর্মরত।
সম্প্রতি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কোর ৪০তম সাধারণ সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘বাংলাদেশ মানসম্মত শিক্ষায় সারা বিশ্বের রোল মডেল হতে চায়। এ লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থায় আরো সংস্কার আনতে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।’ সংবাদ প্রকাশের পর বাংলাদেশের সব নাগরিকের মতো আমিও আশাবাদী। তবে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন। সরকারের দীর্ঘদিনের অনেক চেষ্টার পরেও শিক্ষার হার আশানুরূপ ছিল না, আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনার মতো মহামারি।
বর্তমান বিশ্বে মহামারির কবলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থা। দীর্ঘদিন যাবত্ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ আদেশ অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকবে। সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকতে পারে। মহামারিতে কোনো অবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নেওয়া যাবে না, তেমনি আবার করোনা-পরবর্তী আস্থা মোকাবিলার জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। যেন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানবসম্পদ কোনো অবস্থায় বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় হেরে না যায়। যেহেতু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়, সে কারণেই বিশ্ববাজারে আমাদের সন্তানদের যোগ্যতাও তেমন নয়। এমন অবস্থায় মহামারির সময় সবার মতামতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে মানবসম্পদ সৃষ্টির কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত। করোনার সময় যদি অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা ভালো করা যেত, তাহলে সামনের দিনগুলোতে আমাদের সন্তানদের সামাজিক অবস্থার উন্নতির পাশাপাশি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তুলনামূলক বেশি হওয়ার সুযোগ তৈরি হতো। করোনা-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতির প্রতিযোগিতার যুদ্ধে বাংলাদেশের মানবসম্পদের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে পারে, যদি শিক্ষার মানোন্নয়ন করা যায়। মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান উত্স মানবসম্পদ। আর যার মান বিশ্ববাজারের চাহিদার তুলনায় সন্তোষজনক নয়। সন্তানকে শিক্ষিত করে সম্পদে রূপান্তর একটি দীর্ঘমেয়াদি কাজ, যা বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থার বিবেচনায় প্রায় অর্ধেক মানুষ পারে না বা তাদের জন্য সম্ভব হয়ে ওঠে না। সুতরাং, বর্তমান অবস্থায় সরকারের দায়িত্ব আরো বেড়ে গেছে।
লেখক :এফসিএ, চেয়ারম্যান, এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন-ইডিএ