মাধ্যমিক পর্যায়ে সংশোধিত সৃজনশীল প্রশ্নপত্র
মোসা: রোকসানা ইয়াসমীন।।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সরকারের সিদ্ধান্ত এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়।
শিক্ষাদান পদ্ধতির আধুনিকীকরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনশক্তি রূপে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ) মাধ্যমিক শিক্ষা খাতের গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার ও উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছে। এসব কার্যক্রমের মধ্যে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রবর্তনের মাধ্যমে পাবলিক পরীক্ষার সংস্কার এবং এ বিষয়ে নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষকগণকে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
২০১০ সালে প্রথম এসএসসি পরীক্ষায় বাংলা প্রথম পত্র এবং ধর্ম শিক্ষা বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তারপর ২০১১ সালে বাংলা প্রথম পত্র ও ধর্ম বিষয়সহ সাধারণ শিক্ষা ধারার বিভিন্ন শাখায় (মানবিক, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান) ভূগোল, ব্যবসায় পরিচিতি, সাধারণ বিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়।
মাদ্রাসা শিক্ষার ধারায় দাখিল স্তরে ২০১১ সালে বাংলা ও ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। ২০১২ সাল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উক্ত বিষয়গুলোসহ আরও অতিরিক্ত ১১টি বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
সেসিপ সৃজনশীল পদ্ধতিতে এসএসসি পর্যায়ে প্রশ্নপত্র কীভাবে প্রণয়ন পরিশোধন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হবে সে বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে। সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়নের ধারা কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। এরই লক্ষ্যে ২০১৭ সাল থেকে সারা দেশের সকল শিক্ষকদের পরিবর্তিত সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরিশোধন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে হচ্ছে।
বর্তমানে পরিবর্তিত সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়নে যে সকল বিষয়গুলো সংযুক্ত করা হয়েছে তা হলো:
সৃজনশীল প্রশ্নের ক্ষেত্রে:
১ তিনটি শিখনফলের আলোকে উদ্দীপক তৈরি করা।
২ জ্ঞান এবং অনুধাবনের প্রশ্ন উদ্দীপকের আলোকে না দেয়া।
৩ জ্ঞানমূলক প্রশ্নে ‘কি’ বাদ দিয়ে ‘কাকে বলে’ দেয়া (এটির উত্তর সরাসরি বইয়ে থাকতে হবে)।
৪ অনুধাবনের প্রশ্নে ‘বলতে কি বুঝায়’ বাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করো লিখা।
৫ জ্ঞানের বৈশিষ্ট্যের আলোকে অনুধাবনের প্রশ্ন তৈরি করা।
৬ অনুধাবন প্রশ্নের বাক্য সরাসরি বই থেকে না দেয়া (এক্ষেত্রে সমার্থক শব্দ ব্যবহার করা)।
৭ প্রয়োগের প্রশ্ন উদ্দীপকের একটি শিখনফল থেকে করা।
৮ উদ্দীপকের বাকি দুটি শিখনফল থেকে উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্ন করা।
৯ প্রয়োগ এবং উচ্চতার দক্ষতার প্রশ্নে যেন ওভারলেপিং না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা।
১০ মার্কিন শিক্ষা মনোবিদ বেঞ্জামিন ব্লুম এর ডোমেইন গুলোর ওপর ভিত্তি করে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি করা (জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন, সংশ্লেষণ)।
১১ উদ্দীপক হবে মৌলিক (Unique), এটি পাঠ্যপুস্তকে সরাসরি থাকবে না।
১২ উদ্দীপকে অপ্রয়োজনীয় শব্দ/বাক্য পরিহার করতে হবে।
১৩ উদ্দীপকে প্রশ্নের উত্তর সরাসরি থাকবে না, তবে উত্তর করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে সাহায্য করবে।
১৪ উদ্দীপক এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন উদ্দীপক বাদে শিক্ষার্থীরা ‘ক’ ও ‘খ’ এর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে কিন্তু ‘গ’ এবং ‘ঘ’ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না।
১৫ সৃজনশীল প্রশ্নের বিভিন্ন অংশ (‘ক’, ‘খ’, ‘গ’, ও ‘ঘ’ অংশ) এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যেন বিভিন্ন অংশের উত্তরে পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
১৬ উদ্দীপক অবশ্যই মৌলিক, আকর্ষণীয় ও সংক্ষিপ্ত হতে হবে।
১৭ উদ্দীপক অবশ্যই শিক্ষাক্রম/ সিলেবাস/ পাঠ্যপুস্তকের কোন বিষয়বস্তুর আলোকে প্রণীত হতে হবে
বহুনির্বাচনী প্রশ্নের ক্ষেত্রে:
১ গুরুত্বহীন( Trivial) বিষয় জানার জন্য প্রশ্ন করা যাবে না।
২ উদ্দীপকে কোনোভাবেই উত্তর বা উত্তর পাওয়ার ইঙ্গিত থাকবে না।
৩ প্রতিটি বহুনির্বাচনী প্রশ্নে অবশ্যই এমন তিনটি বিক্ষেপক (Distractors) থাকবে যেগুলো শিক্ষার্থীদের নির্বাচন করার সম্ভাবনা থাকবে। প্রতিটি বিকল্প উত্তর অন্তত শতকরা ৫% শিক্ষার্থীদের নির্বাচন করার সম্ভাবনা থাকতে হবে।
৪ সমাজ বা জনগোষ্ঠীর কোন অংশে বিরূপ বা নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হতে পারে এমন কোনো প্রশ্ন প্রণয়ন করা যাবে না।
৫ বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্রের প্রতিটি অংশের উত্তরগুচ্ছে সঠিক উত্তরের ক্রমবিন্যাস এমনভাবে করতে হবে যেন অনুমান করে সঠিক উত্তর প্রদানের সুযোগ হ্রাস পায়।
৬ একটি বহুনির্বাচনী প্রশ্নের একটিমাত্র সঠিক উত্তর থাকবে।
৭ বহুনির্বাচনীয় প্রশ্ন হবে সুস্পষ্ট।
৮ তিন ধরনের বহুনির্বাচনী প্রশ্ন অবশ্যই থাকতে হবে (সাধারণ বহু নির্বাচনী প্রশ্ন, বহুপদী সমাপ্তি সূচক বহুনির্বাচনী প্রশ্ন এবং অভিন্ন তথ্যভিত্তিক বহুনির্বাচনী প্রশ্ন)।
৯ প্রশ্নের উত্তরে ব্যবহৃত যে সকল সংখ্যা অথবা তথ্য পরিবর্তনশীল সে সকল তথ্য জানার জন্য প্রশ্ন করা যাবে না।
১০ বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্রে চিন্তন দক্ষতার বিভিন্ন স্তরের প্রশ্ন অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
১১ প্রতিটি প্রশ্ন অবশ্যই কারিকুলামের নির্দেশনার আলোকে বিষয়বস্তু ও দক্ষতা যাচাইয়ের উপযোগী হতে হবে।
১২ বর্তমান কারিকুলাম অনুযায়ী ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৩০টি বহুনির্বাচনী প্রশ্নের মধ্যে জ্ঞানমূলক প্রশ্ন করতে হবে ১২টি, অনুধাবনের ৯টি, প্রয়োগের ৬টি ও উচ্চতর দক্ষতার ৩টি প্রশ্ন করতে হবে (বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্রে জ্ঞান ও অনুধাবন স্তরের ৭০% এবং প্রয়োগ উচ্চতর দক্ষতার স্তরের ৩০% প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে)।
১৩ বহুনির্বাচনী প্রশ্নের ভাষা হবে আকর্ষণীয়, সহজ ও প্রাসঙ্গিক।
১৪ বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তরগুলো সংখ্যাবাচক হলে ক্রম অনুযায়ী তালিকাভুক্ত করতে হবে অর্থাৎ ছোট থেকে বড় অথবা বড় থেকে ছোট।
১৫ অনুধাবনের বহুনির্বাচনী প্রশ্নটি অসম্পূর্ণ বাক্য দ্বারা তৈরি করতে হবে।
১৬ Mutually Exclusive/Mutually Inclusive বহুনির্বাচনী করা পরিহার করতে হবে।
১৭ ‘উপরের সবগুলো সঠিক’ অথবা ‘উপরের কোনটি সঠিক নয়’ এরূপ বাক্য পরিহার করতে হবে।
১৮ বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তরের দৈর্ঘ্য সমান হতে হবে।
১৯ বহুনির্বাচনীর উদ্দীপক যথাসম্ভব হ্যাঁ বোধক হতে হবে। না বোধক শব্দ ব্যবহার অনিবার্য হলে তা পরীক্ষার্থীদের দৃষ্টি গ্রাহ্য করে তুলতে হবে।
২০ উদ্দীপকে প্রয়োজনীয় শব্দ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যাতে বিকল্প উত্তর গুচ্ছে কোন শব্দের পুনরাবৃত্তি না থাকে।
২১ উদ্দীপকে এমন কোনো ইঙ্গিত থাকবে না যাতে শিক্ষার্থীর সঠিক উত্তর বাছাই করে নিতে এবং ভুল উত্তর সহজে বাদ দিতে পারে।
২২ বিকল্প উত্তর গুচ্ছ বিষয়বস্তু ও ব্যাকরণগত গঠনের দিক থেকে উদ্দীপকের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।
২৩ অভিন্ন তথ্যভিত্তিক বহুনির্বাচনী প্রশ্নে অবশ্যই উদ্দীপক দিতে হবে এবং উদ্দীপকে তিনটি শিখনফল থাকতে হবে। প্রয়োগের প্রশ্ন হবে একটি শিখনফলে এবং উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্ন হবে দুটি শিখনফলের আলোকে।
সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ) ১২ দিনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে মাস্টার ট্রেইনার প্রণয়ন করে জেলা পর্যায়ে ৬ দিনব্যাপী বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। সারা দেশে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় সর্বশেষ এই প্রশিক্ষণটি পরিচালিত হয়েছে ২৪শে মে ২০২২ থেকে ৩০শে মে ২০২২ পর্যন্ত।
সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এই সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার ফলে শিক্ষার্থীদের মুখস্থনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতির অবসান ঘটেছে এবং শিক্ষার্থীদের চিন্তা, বুদ্ধি ও কল্পনা শক্তির বিকাশ ঘটেছে। সেইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জিজ্ঞাসাপূর্ণ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের এটি একটি যুগোপযোগী পদক্ষেপ।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক (জীব বিজ্ঞান),
কসবা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরিশোধন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন বিষয়ক মাস্টার ট্রেইনার (বিজ্ঞান)