মক্তবের শিক্ষার সোনালি অতীত আবার আসুক ফিরে
একজন মুসলমানের প্রাথমিক শিক্ষার পীঠস্থান হলো মক্তব। যেখানে মুসলমান জাতি জীবনের শুরুতে ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করে থাকে। তাই মুসলিম জাতীয় জীবনে ধর্মীয় ও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাই মক্তবের অবদান অনস্বীকার্য। মক্তব আরবি শব্দ যার অর্থ লেখার কেন্দ্র, শেখার স্থান বা বিদ্যালয়। পারিভাষিক অর্থে মুসলিম পরিবারের শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা অর্জনের জন্য যে স্থানে একত্রিত হয়, তাই মক্তব। মক্তবের শিক্ষা সর্বযুগে সবার জন্য ছিল উন্মুক্ত। মক্তবের শিক্ষার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মহানবী (সা.)-এর হাত ধরেই এর সূচনা হয়েছিল। আর তিনিই ছিলেন প্রথম শিক্ষক। মসজিদে নববীতে বসে মহানবী (সা.) ‘আছহাবে ছুহফা’ নামক সাহাবিদের শিক্ষা দান করতেন। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের মক্তবই হচ্ছে মুসলিম মিল্লাতের প্রথম পাঠশালা। মক্তবে কোরআন, হাদিস শিক্ষার পাশাপাশি ইবাদত-বন্দেগী, গৌসল, নামাজ ও রোজাসহ বিভিন্ন মাসয়ালা শিক্ষা দেয়া হতো।
মক্তবের শিক্ষা ব্যক্তির ব্যবহারিক জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মক্তবে আদব-কায়দা, শিষ্টাচার, সভ্যতা, ভদ্রতা, নম্রতা, সৌজন্যতা, বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করার শিক্ষা দেয়া হয়। তাছাড়া হালাল, হারাম, জায়েজ, নাজায়েজ, পাক-পবিত্রতাসহ সকল বিষয়ে প্রয়োজনীয় জীবন ঘনিষ্ঠ সকল শিক্ষা খুব সহজে দেয়া হয়। মক্তবের প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন শেষে পরবর্তী সময়ে অন্য শিক্ষা অর্জনের পূর্ণ সুযোগ রয়েছে। তাই মক্তবের শিক্ষাকে ধর্ম শিক্ষার সূতিকাগার বলা যেতে পারে। একারণে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্রই মসজিদে মক্তবের শিক্ষার আয়োজন ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সময়ের পরিক্রমায় এটা শুধু আজ কোরআন শিক্ষার প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় এসে পৌঁছেছে। আজ মক্তবে শিক্ষা বন্ধের পথে। অথচ একটা সময় ছিল, শিশুর ইসলামি বুনিয়াদি শিক্ষার প্রাথমিক ভিত্তি ছিল মক্তব। মক্তবের শিক্ষা হারিয়ে যাওযার অন্যতম কারণ বিজাতীয় কালচারাল বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেন, ডে-কেয়ার, ইংলিশ মিডিয়াম, মর্নিং শিফট ও বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল খোলা হয়েছে আছে শহর থেকে গ্রামে যেখানে ভোর সকালে স্কুলে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে শিশুদের। ফলে যেমন মক্তবে শিক্ষার্থী হারিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা বন্ধ হচ্ছে পাশাপাশি মুসলমান শিশু বঞ্চিত হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা থেকে। ফলাফল ধর্মীয় জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ছে আমাদের নতুন প্রজম্ম ও সেখানে বিজয়ী হচ্ছে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি। আর মক্তবের শিক্ষা হারিয়ে যাওয়ার ফলে আজ সামাজিক ও নৈতিক অবজ্ঞয় যে কতটুকু তা সকলের পরিলক্ষিত। আজ ধর্মীয় শিক্ষার অবক্ষয়ের কারণে যুব সমাজের যে অধঃপতন তা বলাই বাহুল্য। জন্মের পর থেকেই একজন শিশু সেই ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মক্তবে যায় না তাদের ধর্মীয় জ্ঞান আজ বন্ধ।
বর্তমানে আমাদের সমাজে একশ্রেণীর অভিভাবক আছে যারা মক্তবের শিক্ষার ব্যাপারে উদাসীন। তারা শিশুদের কচিমনে ইসলামি শিক্ষার পরিবর্তে বিজাতীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রমিত করছে, যা সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র ও জাতির জন্য বিপজ্জনক। আজ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নীতি- নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় কিন্তু তারা কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারে না, কারণ জন্মের পর থেকেই তারা এসব জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। যার ফলে আজকের শিক্ষার্থী যারা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ তারা বিভিন্ন অপকর্ম, নেশা, পর্নোগ্রাফি, ধর্ষণ, খুন, ইভটিজিং ইত্যাদি ইসলাম ও সমাজবহির্ভূত কাজ করতে পিছুপা হয় না, কারণ তাদের মাঝে ইসলামি শরিয়াহ সুন্দর শিক্ষা ও জ্ঞান না থাকা। মুসলিম হিসেবে কি কি কাজ করতে হবে, কি করা যাবে না, এই সম্পর্কে না জানার কারণে আজ সমাজের বড় অংশ যুবসমাজ ধ্বংসের দিকে পা বাড়াচ্ছে।
শতকরা ৮০ ভাগ মুসলিম প্রধান বাংলদেশে আজ পাশ্চাত্য শিক্ষার নামে যে আধুনিকতা জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে তা প্রকৃত অর্থে আধুনিকতা বা উন্নয়ন নয় এক প্রকার অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা। আজ অনেক পরিবারে আধুনিকতার নামে মেয়েদের রাস্তায় বের করা, অমার্জনীয় পোশাক-পরিচ্ছেদ পরিধান করা, নারী ও পুরুষ সমান অধিকার দাবি করা ইত্যাদির কারণে অরাজকতা ও অপরাধ প্রবণতা সমাজে তৈরি হচ্ছে। অথচ ইসলাম মেয়েদের ছেলেদের উপরে স্থান দিয়েছে। সমসাময়িক এই সমস্যাগুলোর আসল কারণ মুসলমান জাতির পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ইসলামি শিক্ষা, শরিয়াহ ও কালচার ত্যাগ করে আধুনিক বেহায়াপনা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গ্রহণ করা। অথচ পৃথিবীর বুকে একমাত্র পূর্ণাঙ্গ, সুন্দর গতিশীল জীবন ব্যবস্থা হলো ইসলাম। ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা ও জ্ঞান যদি প্রতিটি পরিবারে মাঝে থাকতো, তাহলে তারা বড় হয়ে ইসলাম বিদ্বেষী কাজ করতে সাহস পেত না।
মুসলমানদের একটি বড় ক্ষেত্র যে আখিরাত আর আখিরাতে যে দুনিয়ার সকল অপকর্মের শাস্তি পেতে হবে এই জ্ঞান আমাদের পরিবারে থাকলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে আমরা, আবারো পৃথিবী শাসন করতাম। ইসলাম যে একটি ধর্মের নাম নয় একটি প্রগতিশীল জীবন ব্যবস্থা এ সম্পর্কে একজন শিশু প্রথম শিক্ষা লাভ করে মক্তবে। আর একজন শিশুর মাথায় এই ইসলামি শিক্ষা কোরআন, হাদিস, মাসয়ালা, আখলাক, চরিত্র, নীতি-নৈতিকতা, আদব-কায়দা, সম্মান, স্নেহ ইত্যাদি শিক্ষা দিতে পারলে সে ভবিষ্যতে কখনো ইসলাম বিরোধী কাজ করতে সাহস পাবে না। একটা সময় এমন ছিল যে, তখন মানুষ স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় যাক বা না যাক মক্তবে যায়নি এমন মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। সকলে বলতেন যে কোথাও শিক্ষা অর্জন করি আর না করি মক্তবে পড়েছি। এ থেকে বুঝা যায়, তখন মক্তবে সকলেই ইসলামি দ্বীন শিক্ষায় যেত।
বর্তমান সময়ে অনেকে বলে থাকেন যে, আমরা আমাদের ছেলেমেয়দের বাড়িতে শিক্ষক রেখে কোরআন শিক্ষা দেই। তা শুধু যেমন কোরআন শিক্ষার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে এতে করে ইসলামি জীবন পরিচালনার বাকি বিষয়গুলা থেকে তারা বঞ্চিত হয়।
প্রতিযোগিতামূলক অনুশীলন ও চর্চা বা থাকার কারণে পরবর্তী জীবনে আমাদের শিশুরা যেমন কোরআন ভুলে যাচ্ছে এবং দ্বীনি বিষয়ে জ্ঞান না থাকার কারণে বিপথে চলে যায়। আর মক্তবে তাজবিদসহ কোরআন শিক্ষার সাথে দ্বীনি বিষয়েও শেখানো হয়। যদিও আমাদের দেশে কোরআন ও দ্বীনি শিক্ষার জন্য মাদরাসার এখন অভাব নেই। তবে, এর বাইরেও কিন্তু প্রচুর শিক্ষার্থী আছে যারা মাদরাসায় পড়ছে না। তারা দ্বীনি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের কোরআন ও বুনিয়াদি শিক্ষার ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হবে যার বিকল্প হলো মক্তব। বেশকিছু দিন আগেও গ্রাম কিংবা শহরে প্রভাতী মক্তব চালু ছিল যেখানে শিশুদের কোরআন তেলাওয়াত ও দ্বীনি শিক্ষার মুখরিত হতো পথ ও প্রান্তর। কোথাই হারিয়ে গেলো সেই সোনালি অতীত?
পরিশেষে দুঃখের সাথে বলতে হয়, গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী পিঠস্থান আজ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়ার প্রান্তে। মক্তবের শিক্ষার মূল্যবান সময়টুকু যদি পুনরুদ্ধার করা না যায়, তাহলে এটা নিশ্চিত যে ইমান-আকিদায় সমৃদ্ধ মুসলমান জাতি ভবিষ্যতে একটি দুর্বল জাতিতে পরিণত হবে যা বলাই বাহুল্য। বর্তমান প্রজন্মকে ইসলামি বুনিয়াদি শিক্ষা দেয়া না হলে, চিরতরে হারিয়ে যাবে জাতির ভবিষ্যৎ। এই জাতি মদ, জুয়া, জিনা, ব্যভিচার ও নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত হবে। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব দেশে ইতোমধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। তাই মক্তবের শিক্ষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে পুনরায় চালু রাখা সর্বমহলের নৈতিক দায়িত্ব। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়া সমাজকে পুনর্গঠনে আমাদের কর্তব্য হলো ব্যক্তি থেকে শুরু করে সামাজিক পর্যায়ে মক্তব শিক্ষার বিষয়ে জোর দেয়া। মক্তবের শিক্ষাকে গণমুখী ও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা। এই শিক্ষার দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে তুললে প্রয়োজনে আর্থিকভাবে সহায়তা দিয়ে দেশের সুশীল সমাজ, শিক্ষাবিদ, ইমাম-খতিব, সাধারণ মানুষ ও সকল অভিভাকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মক্তবের শিক্ষার, সোনালি অতীত আবারো আসুক ফিরে এটাই কাম্য।
লুৎফর রহমান লাভলু
ঢাকা কলেজ, ঢাকা।