ভয়াবহ বন্যা : অন্ধকার দেখছেন ক্ষতিগ্রস্ত খামারি ও কৃষকরা
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
এবার বোরো মওসুমের শুরুতে সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যায় প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই সাম্প্রতিক সময়ে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ওই এলাকার বিস্তীর্ণ জনপদ ডুবে গেছে। বন্যার ভয়াবহতা এমন যে, গোলা ভরা ধান এবং গোয়ালে গরু রেখেই অনেককে প্রিয়জনদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে।
কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে আউশ ধানের পরিমাণ প্রায় ৬৩ হাজার। বাকিটা শাকসবজি। সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ২০৫৪টি খামার (গরু, মহিষ, ছাগল) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এতে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ৩১৭ কোটি টাকা। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে প্রায় ৭০ হাজার মৎস্য খামার। এতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণে বাড়বে। এ ছাড়া শুধু সিলেট অঞ্চল নয়, দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলেও বিস্তৃত হচ্ছে বন্যা। বন্যায় কৃষক ও খামারিরা ব্যাপক লোকসানের মধ্যে পড়তে যাচ্ছেন। এতে যেমন ব্যক্তি পর্যায়ে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তেমনি দেশের খাদ্যনিরাপত্তাও হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এখন মাঠে বড় ধরনের কোনো ফসল নেই। তারপরও চলমান বন্যায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারীসহ ১৫ জেলায় প্রায় ৫৬ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া শাকসবজি, তিল, বাদাম প্রভৃতি ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
বন্যা দীর্ঘস্থায়ী না হলে এখন পর্যন্ত যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, সেটা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব। সেজন্য ইতোমধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতিও শুরু করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: সায়েদুল ইসলামের সভাপতিত্বে বন্যায় কৃষিখাতের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সূত্র জানায়, কৃষি সম্প্রসারণ জানিয়েছে যে, এখন পর্যন্ত ১ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে ৬৩ হাজার আউশ ধান এবং বাকিটা শাকসবজির ক্ষেত। তবে এটা প্রাথমিক তথ্য। এর পরিমাণ আরো বেশি হতে পারে কিংবা আরো বাড়তে পারে।
এর আগে গতকাল সকালে সচিবালয়ে মালদ্বীপের হাইকমিশনার শিরুজিমাথ সামীর সাথে বৈঠক শেষে কৃষিমন্ত্রী বন্যায় কৃষিতে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি বলেন, দেশে আমন একটি বড় ফসল, যেখানে বছরে ১ কোটি ৫০ লাখ টনের মতো চাল উৎপাদন হয়। এখন রোপা আমনের বীজতলা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। বন্যা আর না বাড়লে বীজতলা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তবে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ড. রাজ্জাক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমনের বীজতলা তৈরির জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যেসব বীজতলা করা হয়েছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে আবার করা হবে। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত বীজ সংরক্ষিত আছে, সেগুলো চাষিদের দেয়া হবে।
অন্য দিকে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে নাবী জাতের (লেইট ভ্যারাইটি) ধান চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। মন্ত্রী বলেন, সব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। বন্যার কারণে যদি আমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা চাষ না করা যায়, তাহলো রবি মৌসুমে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হবে। সেজন্য ক্ষতি পোষাতে কৃষকদের বীজ, সেচ, সারসহ বিভিন্ন উপকরণ বিনামূল্যে দেয়া হবে। চলমান বন্যার কারণে শাকসবজির দামে প্রভাব পড়তে পারে বলে জানান মন্ত্রী।
তিনি বলেন, এ বন্যার কারণে দেশে খাদ্যসঙ্কট হবে কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব (বর্তমানে সম্প্রসারণ উইংয়েরও দায়িত্বপ্রাপ্ত) বলাই কৃষ্ণ হাজরা বলেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো পুরোপরি নিরূপণ হয়নি। আমরা কৃষককে বীজ ও সার দেয়ার পাশাপাশি পুনর্বাসন কর্মসূচি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত দুই হাজারের বেশি খামার : সিলেট সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যায় অনেক কৃষকেরই গরুসহ অন্যান্য প্রাণি ভেসে গেছে। পাশাপাশি বাণিজিক্যভাবে বিশেষ করে আসন্ন কোরবানির ঈদের জন্য লালন-পালন করা বিপুল পরিমাণ গরু-ছাগলের খামারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে, চলমান বন্যায় দেশের ১২টি জেলার ৭৪টি উপজেলার দুই হাজার ৫৪টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে খামারিদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩১৭ কোটি টাকা। তবে ক্ষতিগ্রস্ত খামারের সংখ্যা এবং আর্থিক পরিমাণ আরো বেশি বলে মনে করছে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো: ইমরান হোসেন বলেন, বন্যার পানির ¯্রােতে গবাদিপশু ভেসে গেছে। অনেকের গরু আবার চুরি হয়ে গেছে।
অনেক পশু মারা গেছে। অনেকে আবার গবাদিপশু নিয়ে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে গেছেন। গবাদিপশুর সাথেই মানুষজন থাকছেন। মানুষের যেমন খাবারের প্রয়োজন তেমনি পশুর জন্যও খাদ্য প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মানুষের সাথে প্রাণী বা গবাদিপশুর খাদ্যও নিশ্চিত করতে হবে। নইলে তো মারা যাবে। পানিবাহিত রোগ থেকে পশুকুল রক্ষায় প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্রে (যেখানে পশু রয়েছে) পর্যাপ্ত ভেটেরিনারি ডাক্তারকে দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা: মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা জানান, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন যেন মানুষের সাথে পশু খাদ্যেরও সহায়তা দেয়া হয়। সেভাবেই হচ্ছে। আমরা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ভেটেরিনারি চিকিৎসক দিচ্ছি। যাতে কোনো সমস্যা না হয়। ভেসে গেছে ৭০ হাজার মৎস্য খামার : চলমান বন্যায় ৫ বিভাগের ১৫টি জেলার ৯৩টি উপজেলার প্রায় ৭০ হাজার মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে। যার পরিমাণ প্রায় ১৮ হাজার মেট্রিক টন।
পোনা বের হয়ে গেছে ৫৭ হাজার ৫৭৯ লাখ বা ৫৭৫ কোটি ৭৯ লাখ পোনা মাছ। মাছ ও মাছের পোনা মিলে ক্ষতি হয়েছে ১৬০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত মাছের খামারিদের বাণিজ্যিক মূল্য ১২৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। মাছের পোনার বাণিজ্যিক মূল্য ২১ কোটি ৭ লাখ টাকা। এ ছাড়াও অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে ৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা। মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক খ মাহবুবুল হক বলেন, সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ১৬০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতিদিনই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ জানতে আরো সময় লাগবে। বিভিন্ন সূত্র বলছে এর পরিমাণ ২০০ কোটি টাকার নিচে নয়। হাজার হাজার মৎস্য খামারি ক্ষতি শিকার হয়েছেন। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে চলমান বন্যায় যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা খুব সহজেই দূর হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। কৃষক বা চাষি পর্যায়ে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হওয়ার পাশাপাশি আগামী দিনের খাদ্যনিরাপত্তাও ঝুঁকিতে ফেলেছে।