ভেড়ামারা: ১৭ শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক ১২ জন
কুষ্টিয়াঃ উপজেলা শিক্ষা অফিসে কাগজে-কলমে ১৩৬ শিক্ষার্থীর তালিকা দেওয়া আছে। হাজিরা খাতায় নাম লিপিবদ্ধ আছে ৫৬ ছাত্রীর। কিন্তু বাস্তবে পাঁচটি ক্লাস মিলে প্রতিদিন মাত্র ১৭ থেকে ১৮ শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। আর তাদের জন্য শিক্ষক রয়েছেন ১২ জন। কর্মচারী আছেন তিনজন। এ চিত্র কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার আবদুল হক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের।
জানা যায়, ভেড়ামারার বাহিরচর ষোলদাগ এলাকায় মেয়েদের শিক্ষার প্রসারে ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আবদুল হক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষা অনুরাগী এ এম মুসা। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মরহুম শাহ সূফী হজরত মাওলানা ডা. হাফেজ আবদুর রশীদ। ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যালয়ে বর্তমানে আগের মতো লেখাপড়ার মান নেই। এ কারণে দিনে দিনে ছাত্রী সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ অবস্থা বিরাজ করছে এ বিদ্যালয়ে। অর্থাৎ কাগজে-কলমে ১৩৬ শিক্ষার্থীর তালিকা থাকলেও প্রতিদিন গড়ে মাত্র ১৭ থেকে ১৮ জনের বেশি স্কুলে আসে না। শিক্ষার মান উন্নয়ন ও যুগোপযোগী করতে শিক্ষকদের কোনো চেষ্টা নেই। কিন্তু শিক্ষকরা প্রতি মাসে সরকারি বেতন উত্তোলন করেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এর আগে রওশন আরা বেগম প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন শিক্ষা কার্যক্রম ভালো চলছিল। ২০১৬ সালে তিনি অবসরে যাওয়ার পর ম্যানেজিং কমিটিকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে মো. আনোয়ার হোসেন প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। যোগদানের কিছুদিন পর থেকেই বিদ্যালয়ে নানা অনিয়ম শুরু করেন তিনি। তার গাফিলতির কারণে বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান নিম্নমুখী হতে থাকে। নানা বিষয় নিয়ে কমিটির সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের বিরোধ সৃষ্টি হয়। বর্তমানে পদাধিকার বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আকাশ কুমার কুণ্ডু ওই বিদ্যালয়ের সভাপতি। তারপরও প্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্ব অব্যাহত রয়েছে। নামকাওয়াস্তে চলছে ম্যানেজিং কমিটির কার্যক্রম। বিদ্যালয়ে হয় না অ্যাসেম্বলি। গাওয়া হয় না জাতীয় সংগীত। ম্যানেজিং কমিটির মিটিংও হয় না। বিদ্যালয়ের মাঠ গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকদের মধ্যে মিল নেই। প্রধান শিক্ষকের কথা কেউ শোনেন না। সহকারী শিক্ষকরা মর্জিমাফিক চলেন। অনেকে নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন না। কিন্তু হাজিরা খাতায় সই দিয়ে বেতন তোলেন নিয়মিত। এসব কারণে সচেতন অভিভাবকরা এখানে তাদের মেয়েদের ভর্তি করাতে চান না।
গত বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সব শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা খুবই কম। বেঞ্চগুলো এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে। বড় একটি কক্ষে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ক্লাস চলছে। মাত্র ৩ জন ছাত্রীকে পাঠদান করাচ্ছেন সহকারী শিক্ষক রোজিনা খাতুন। ৭ম শ্রেণিতে ৬ ছাত্রীকে পড়াচ্ছেন শিক্ষক তোহিদুল ইসলাম সান্টু। ওই দিন ষষ্ঠ থেকে দশম পর্যন্ত পাঁচটি শ্রেণিতে মোট ১৭ ছাত্রী উপস্থিত ছিল। পরে অফিস কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন শিক্ষক খোসগল্পে মেতে আছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এ রকম চিত্র প্রতি কার্যদিবসের।
সহকারী শিক্ষক তোহিদুল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থী আছে। সেই শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো উপস্থিত হয় না। কেন আসে না, তা বলতে পারব না।
অন্যদিকে আজিজুল হক ও আবদুল ওয়াহাব নামে দুজন সহকারী শিক্ষক বলেন, আমাদের এখানে ছাত্রী সংখ্যা খুবই কম। অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানকে পড়ানোর জন্য শহরমুখী। অনেকে আবার এখান থেকে নিয়ে এলাকার অন্য স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন। এখানে যারা ভর্তি আছে, তারাও ঠিকমতো বিদ্যালয়ে আসে না। যে কয়জন আসে তাদের নিয়মিত পাঠদান করা হয়।
প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সত্য নয়। বরং সহকারী শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে ঠিকমতো আসেন না, পড়ান না। এ কারণে শিক্ষার মান কমেছে, শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও কমে গেছে। যেসব মেয়ে স্কুলে আসে না, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য শিক্ষকদের যেতে বলেছি, তারা যান না। তারা আমার কথা শোনেন না।
উপজেলা মাধ্যমিক ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, আমি জানি আবদুল হক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক কম। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানিয়েছি।
বিদ্যালয়ের সভাপতি ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আকাশ কুমার কুণ্ডু বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। তেমন কিছু জানি না। তবে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে কিছুদিন ধরেই অভিযোগ আসছে। বিস্তারিত জানা ও দেখার জন্য অচিরেই বিদ্যালয় পরিদর্শনে যাব। ত্রুটিগুলো নিয়ে বিধি মোতাবেক দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৯/০৯/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়