‘ভুয়া প্রশ্ন’ ফাঁস চক্রের টার্গেট বোর্ড পরীক্ষা
নিউজ ডেস্ক।।
ভুয়া ফেইসবুক আইডি থেকে গ্রুপ খুলে এসএসসি ও এইচএসসিসহ বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার ভুয়া প্রশ্ন ফাঁসের রমরমা কারবার চালাচ্ছে বেশ কিছু প্রতারক চক্র। ‘পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি অল অল এক্সজাম হেল্পিং জোন’, ‘এসএসসি ব্যাচ ২০২১’, ‘এসএসসি পরীক্ষার্থী ২০২১’, ‘সার্টিফিকেট লাগবে’, ‘এসএসসি ব্যাচ ২০২১ এক্সজাম প্রিপারেশন’ ফেইসবুকে এমন হরেক নামের গ্রুপের এখন ছড়াছড়ি। ভুয়া ফেইসবুক আইডি থেকে এসব গ্রুপ খুলে বছরজুড়ে ফলোয়ার (অনুসারী) বাড়ায় প্রতারক চক্রের সদস্যরা। প্রতিটি গ্রুপেই ফলোয়ার রয়েছে হাজার হাজার পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা, যারা লোভের ফাঁদে পা দিয়ে বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন। প্রতারক চক্রগুলো প্রশ্ন দেওয়ার নামে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
এমনকি এসব প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেক নারী শিক্ষার্থী ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকারও হয়েছেন। এসব চক্রের সদস্যদের একটি বড় অংশ তরুণ ও মাদকাসক্ত। তাদের অনেকে মাদকের টাকা জোগাড় করতে বেছে নিয়েছে এ ধরনের প্রতারণার পথ। সংশ্লিষ্ট ফেইসবুক গ্রুপগুলো ঘেঁটে এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত ১৪ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা। আর আগামী ২ ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা। এ দুটি বোর্ড পরীক্ষাকে টার্গেট করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভুয়া প্রশ্ন ফাঁসের বেশকিছু প্রতারক চক্র। এমন দুটি চক্রের সদস্যদের ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি সদস্যরা।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তারা জানান, প্রতারক চক্রগুলো পরীক্ষার প্রকৃত প্রশ্ন দিতে পারে না। মূলত পরীক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদের ফেইসবুক আইডি ও ফোন নম্বর ব্লক করে দেয়।
প্রশ্ন ফাঁসের কথা বলে ফেইসবুক গ্রুপে পোস্ট করে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গত ১৬ নভেম্বর পাবনার হরিরামপুর থেকে মো. সজীবুর রহমান ওরফে শাওন এবং ময়মনসিংহের নান্দাইলের দক্ষিণ চরিআনিপাড়া থেকে কায়কোবাদ ওরফে সাব্বিরকে গ্রেপ্তার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। এছাড়া এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগের রাতে ১৩ নভেম্বর একই অভিযোগে করিমুল্লাহ, আল রাফি ওরফে টুটুল ও আব্দুল্লাহ আল মারুফ ওরফে তপুকে গ্রেপ্তার করে ডিবির গুলশান বিভাগ।
বিভিন্ন ফেইসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা গেছে, একটি ফেইসবুক আইডি থেকে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন লাগলে বা ফলাফল পরিবর্তন করতে চাইলে যোগাযোগ করতে বলে পোস্ট দেওয়া হয়েছে। সেসব পোস্টে যোগাযোগের জন্য একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরও দেওয়া হয়েছে। আরেকটি আইডি থেকে দেওয়া পোস্টে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন নিতে চাইলে ইনবক্সে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। এসব পোস্ট দেখে অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। তাদের অনেকে আবার প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
এর আগে গত বছর পরীক্ষার প্রশ্ন দেওয়ার কথা বলে এক ছাত্রীর সঙ্গে সখ্য গড়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন ও ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে ডিবির গুলশান বিভাগ।
ডিবির তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চক্রগুলো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরবরাহের কথা বলে বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট করে প্রচার করে। পরীক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে প্রশ্নপত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। অনেকে প্রশ্নপত্র পাওয়ার আশায় চক্রের দেওয়া হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে এবং ফেইসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করে। এরপর পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে প্রশ্ন না দিয়েই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে চক্রের সদস্যরা। আবার অনেক সময় ভুয়া প্রশ্ন দেয় যার সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নের কোনো মিল থাকে না।
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার সাব্বির জানায়, অনলাইন থেকে বিগত বছরের বোর্ডের প্রশ্নপত্র এবং বিভিন্ন গ্রুপে সাজেশন হিসেবে দেওয়া প্রশ্নপত্র ডাউনলোড করে তা এডিট (সম্পাদনা) করে তারা ভুয়া প্রশ্ন তৈরি করত। এসব প্রশ্ন ফাঁস করার দাবি করে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করত। এ কাজের জন্য তারা ফেইসবুকে ভুয়া আইডি তৈরি করত। আর প্রশ্ন দিত হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। আবার কাউকে কাউকে তারা জাল সার্টিফিকেটও বানিয়ে দিত টাকার বিনিময়ে।
ডিবির তদন্তে সাব্বিরের বিরুদ্ধে একাধিক মাদক মামলা থাকার বিষয়টিও উঠে এসছে। তার বিরুদ্ধে ময়মনসিংহের নান্দাইল থানায় ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চারটি মাদক মামলা হয়েছে। তিনি নিয়মিত মাদক সেবনের পাশাপাশি কারবারের সঙ্গেও জড়িত।
ভুয়া প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে প্রতারণার ঘটনায় গত ১৭ নভেম্বর ডিএমপির রমনা থানায় একটি মামলা হয়। এর এজাহারে বলা হয়েছে, হুমায়ুন আহম্মেদ তালুকদার নামে একটি ফেইসবুক আইডি থেকে ‘এক্সজাম সাজেশন অব এসএসসি ব্যাচ ২০২১’ নামের একটি গ্রুপে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন নিতে চাইলে ইনবক্সে যোগাযোগের কথা জানিয়ে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। একই আইডি থেকে আরও কিছু পোস্ট করা হয়। পরে ডিবির হাতে গ্রেপ্তারের পর দেখা যায় ওই ফেইসবুক আইডিটি সজীবুর রহমানের। গ্রেপ্তার সাব্বিরও ভুয়া নামে ফেইসবুক আইডি খুলে প্রশ্ন ফাঁসের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল।
এর আগে গত ১৩ নভেম্বর ঢাকার উত্তরা, গাজীপুরের পুবাইল এবং নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। অভিযানে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার সময় কিছু প্রতারক চক্র টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার চেষ্টা করে। এতে ব্যর্থ হলে প্রশ্ন ফাঁস করার নামে প্রতারণার জন্য বিভিন্ন প্যাকেজ নিয়ে ফেইসবুক, মেসেঞ্জার এবং অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক মাধ্যমে প্রচারণা চালায়।
এরা মূলত বিভিন্নভাবে ভুয়া ফেইসবুক আইডি খুলে মেসেঞ্জারে এবং ফেইসবুকে ১০০ শতাংশ নিশ্চয়তা সহকারে বিভিন্ন বোর্ডের সব বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁস করার বিজ্ঞাপন দেয়। তাদের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ার জন্য পরীক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকদেরকে প্রাথমিকভাবে ৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা দিয়ে সদস্য হতে হয়। চক্রের সদস্যরা পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকদেরকে বলে ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলা এবং জেলা থেকে পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রশ্ন বহনকালে দায়িত্বশীলদের একজন কৌশলে প্রশ্ন সরিয়ে রেখে ছবি তুলে পাঠিয়ে দেবে। সেই ছবি তারা মেসেঞ্জার, টেলিগ্রাফ ও জি-মেইল ব্যবহার করে পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকদেরকে পাঠাবে। এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা নগদ, বিকাশ ও রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে পরীক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রতিটি প্রশ্নের জন্য ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা করে নিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের টিম ইনচার্জ অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) আশরাফউল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষাকে সামনে রেখে একাধিক চক্র ফেইসবুকে সক্রিয় হয়ে ওঠে। পরীক্ষার প্রশ্ন দেওয়ার কথা বলে অনেকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। এদের ওপর আমাদের মনিটরিং অব্যাহত আছে।’