ভুল তথ্য দেওয়া প্রতিষ্ঠানের এমপিও বাতিল হবে
ভুল তথ্য দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো এমপিও পেয়ে থাকলে তা বাতিল করা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইন।
তিনি বলেন, চারটি শর্ত দেখে এমপিও দেয়া হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান শর্ত অনুসরণ করেছে শুধু সেগুলোই এমপিও পেয়েছে। যখন স্বীকৃতিকে শর্তের মধ্যে আনা হয়েছে তখন ধরেই নেয়া হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি বাস্তবে আছে এবং সেটি ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হচ্ছে না। তাই এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বা ভুল তথ্য দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো এমপিও পেয়ে থাকলে তা বাতিল করা হবে। একথা এমপিওর আদেশেই বলা আছে।
সোহরাব হোসাইন বলেন, আওয়ামী লীগের অনেক বড় নেতার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান যেমন এমপিও পায়নি, আবার অন্য দলের নেতাদের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান এমপিও পেয়েছে। এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়নি বলেই এমনটি হয়েছে। কেননা, সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই এ দেশের মানুষের সন্তানরা লেখাপড়া করে। তাই শতভাগ নীতিমালা অনুযায়ীই এবার এমপিও দেয়া হয়েছে।
নতুন এমপিওভুক্তির জন্য গত বছরের আগস্টে আবেদন করে ৯ হাজার ৬১৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে ২ হাজার ৭৩০টি প্রতিষ্ঠানকে বুধবার এমপিওভুক্তির ঘোষণা দেয়া হয়। এমপিওপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের হার ২৮ শতাংশ। নীতিমালার একাধিক ধারায় ফেলে ২০৪টি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় এমপিও দেয়া হয়েছে। সেই হিসাবে ৭ হাজার ১৫টি প্রতিষ্ঠানই অযোগ্য। এসব প্রতিষ্ঠানে কাম্য শিক্ষার্থী নেই, পাসের হার নেই। আছে আরো নানা সমস্যা।
নীতিমালা অনুযায়ী চার শর্ত পূরণ করলে এমপিও পাওয়া যায়। শর্তগুলো হল- প্রতিষ্ঠানের বয়স বা স্বীকৃতির মেয়াদ, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাসের হার। প্রতিটি পয়েন্টে ২৫ করে নম্বর থাকে। কাম্য শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এবং স্বীকৃতির বয়স পূরণ করলে শতভাগ নম্বর দেয়া হয়। সর্বনিম্ন ৭০ নম্বর পাওয়া প্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্তির জন্য বিবেচিত হয়েছে। এবারে আবেদন করা প্রায় ৭২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান যোগ্যতা ও শর্তপূরণ করতে না পারায় এমপিও পায়নি।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় অর্ধশত অযোগ্য অথবা প্রায় অস্তিত্বহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবার এমপিওভুক্ত হয়েছে। ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত, শিক্ষার্থী নেই, পাস নেই, স্কুল ঘর নেই এবং সরকারি হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানও এমপিও পেয়েছে। এমপিওভুক্ত হওয়া প্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্তির তালিকায় স্থান পেয়েছে। যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি, শান্তি কমিটির নেতা এবং বিএনপি-জামায়াত নেতাদের প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও এমপিও পেয়েছে। এতে বোঝা যায় তালিকা যাচাই-বাছাই কতটা উদাসীনভাবে হয়েছে।
এই যাচাই-বাছাই কমিটির প্রধান ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. জাবেদ আহমেদ। তিনি বিএনপি-জামাত আমলের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. লুৎফুজ্জামান বাবরের খুব ঘনিষ্ঠ এবং বাবরের অধীনে চাকরি করেছেন কয়েকবছর।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, পঞ্চগড়ের আটোয়ারি উপজেলার সন্দেশদীঘি নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে ৩ বছরে ২০ জন জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী ৩ বছরে প্রতিষ্ঠানটি থেকে ১২০ জন পরীক্ষা দেয়ার কথা। প্রতি বছর সর্বনিম্ন ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করতে হবে। গত ২ বছরে যথাক্রমে ৩০ ও ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। ২০১৬ সালে দু’জন পরীক্ষা দিয়ে শতভাগ পাস করেছে। নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হওয়ার কথা নয়।
আবার একই জেলার বোদা উপজেলার ঝলইশাল শিরি ইউনিয়নের নতুন হাট টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। যদিও চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানটি থেকে ৬০ জন অংশ নেয়। তাদের মধ্যে ৫৮ জন পাস করেছে। কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠানটি এবার এমপিও পেয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার পর রাতারাতি প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ইটের গাঁথুনির ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই অনলাইনে তথ্য দিয়েছে। ওইসব তথ্য যাচাইয়ের ব্যবস্থা ছিল বলে বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। কিন্তু এমপিও তালিকা প্রকাশের প্রমাণিত হয়েছে, তথ্য যাচাই হয়নি। এ কারণে ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত, অস্তিত্বহীন এবং জাতীয়করণ হওয়া প্রতিষ্ঠানও এমপিও পেয়েছে। এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকার বাড্ডার ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজ ভাড়া বাড়িতে আছে। এমন আরো কিছু প্রতিষ্ঠান আছে। সরকারি হওয়ার পরও এমপিও পাওয়া প্রতিষ্ঠানের নাম হবিগঞ্জের মাধবপুরের শাহজালাল কলেজ।
নতুন এমপিও পেয়েছে ১৪২৮ প্রতিষ্ঠান: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৭৩০টির মধ্যে নতুন এমপিও পেয়েছে ১৪২৮টি। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন স্তর এমপিও পেয়েছে। অর্থাৎ, ওইসব প্রতিষ্ঠানের নিুস্তর এমপিওভুক্ত ছিল। নতুন এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিু মাধ্যমিক স্তরের প্রতিষ্ঠান ৪৩৯টি ও মাধ্যমিক স্তরের (ষষ্ঠ থেকে ১০ শ্রেণি) প্রতিষ্ঠান ১০৮টি। মাদ্রাসা আছে ৩৫৯টি। বাকি ৫২২টি কারিগরি প্রতিষ্ঠান। ৬২টি কৃষি ইন্সটিটিউট, ৪৮টি ভোকেশনাল (স্বতন্ত্র), ১২৯টি ভোকেশনাল (সংযুক্ত), ১৭৫টি বিএম (স্বতন্ত্র), ১০৮টি বিএম (সংযুক্ত) প্রতিষ্ঠান এবার এমপিও পেয়েছে।
এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, স্বীকৃতির একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব ভূমিতে পরিচালনা করতে হয়। সেই সময়টা ধরেই স্বীকৃতিকে এমপিওভুক্তির শর্তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যদি একটা সময়ের পরও ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হয় তাহলে এর দায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের। বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তাদের কারণে ভুলের দায় এখন নিতে হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে।