ভুল চিকিৎসার দায়..
এম মামুন হোসেন।।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আল নাঈন তাজবিদ (৮) নামে এক শিশুর খতনার সময় পুরুষাঙ্গের একাংশ কেটে ফেলা হয়। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান নোয়াখালী জেলার সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার। খতনা করাতে গিয়ে গত মঙ্গলবার রাতে আহনাফ তাহমিদ নামে ১০ বছরের আরেক শিশু মারা যায়।
খতনা করাতে আহনাফ তাহমিদকে গত মঙ্গলবার রাত পৌনে ৮টায় রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার জেএস ডায়াগনোস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ খতনা করানো শেষ হয়। এরপর এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও শিশুটির চেতনা ফিরে আসেনি। শিশুটির পরিবারের অভিযোগ, অনুমতি না নিয়ে ‘ফুল অ্যানেসথেসিয়া’ দেওয়ায় শিশুটির মৃত্যু হয়েছে।
মাস দেড়েক আগে খতনা করাতে গিয়ে আয়ান নামে আরেক শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। পাঁচ বছর বয়সি আয়ানকে খতনা করাতে গত বছর ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর সাঁতারকুলের ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যায় তার পরিবার। অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর শিশুটির আর জ্ঞান ফেরেনি। পরে তাকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে স্থানান্তর করে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। গত ৭ জানুয়ারি সেখানেই শিশুটির মৃত্যু হয়। পরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অভিযানে দেখা গেছে, হাসপাতালটির লাইসেন্স নেই।
সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন মাহবুবা রহমান আঁখি। প্রসব ব্যথা নিয়ে গত বছর ৯ জুন রাত ১২টা ৫০ মিনিটে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ওই চিকিৎসকের অধীনে ভর্তি করা হয় তাকে। কিন্তু ডা. সংযুক্তা সাহা দেশেই ছিলেন না। অন্য চিকিৎসকের মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টা ব্যর্থ হলে অস্ত্রোপচার করে বাচ্চা বের করা হয়। পরদিন মারা যায় শিশুটি। ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী মাহবুবা রহমান আঁখিও মারা যান।
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভুল চিকিৎসা প্রমাণ করা কঠিন। কোনো চিকিৎসক ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো রোগীকে মেরে ফেলতে চান না। একজন চিকিৎসকের কাজ রোগীকে সুস্থ করে তোলা। অনিচ্ছাকৃত ভুল বা অজ্ঞতাবশত ভুল হতে পারে। তাই দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসা নিতে গিয়ে অন্যায় আচরণ, অবহেলা বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর অঙ্গহানি বা প্রাণ হারানোর ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সুবিচার পেয়েছে এমন উদাহরণ খুব কম। দেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীর সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। তবে হাসপাতালে অবহেলাজনিত কারণে কিংবা ভুল চিকিৎসায় রোগীর অঙ্গহানি হলে কিংবা প্রাণ হারালে তিনভাবে প্রতিকার চাওয়া যায়। এর মধ্যে কোনো হাসপাতালের বিরুদ্ধে রোগীর অভিযোগ থাকলে প্রতিকার চেয়ে অভিযোগ করা যাবে স্বাস্থ্য অধিদফতরে। কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে অভিযোগ করা যায় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি)। ফৌজদারি অপরাধ হলে প্রচলিত ফৌজদারি আদালতে মামলা করা যায়।
চিকিৎসকদের অবহেলার অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে যেতে পারলেও প্রতিষ্ঠানটির ওপর আস্থা রাখেন না অনেকে। বিএমডিসিতে যারা কর্মরত আছেন, তারা সবাই চিকিৎসক। ফলে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিকারের নজির কম। এতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রায়শ তার ক্ষোভ হাসপাতাল বা ক্লিনিকেই প্রকাশ করেন। যার ফল হলো ভাঙচুর বা চিকিৎসককে মারধর। সবচেয়ে বড় সমস্যা, রাজধানীতে বিএমডিসির কার্যালয় মাত্র একটি। সেখানে কেউ অভিযোগ নিয়ে গেলেও সময় লেগে যায় অনেক বেশি।
বিএমডিসির তথ্য মতে, চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার অভিযোগে ২০১০ সালে চারটি অভিযোগ জমা পড়ে। পরের পাঁচ বছরে জমা পড়ে মাত্র চারটি। ২০১৬ সালে ছয়টি, ২০১৭ সালে ১৪টি, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ২৬টি করে, ২০২০ সালে আটটি, ২০২১ সালে ৩২টি এবং ২০২২ সালে ৩১টি আর ২০২৩ সালে জমা পড়ে ৩৭টি অভিযোগ।
এসব অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৪টি, যা জমা পড়া অভিযোগের ১২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ৫০ জন চিকিৎসকের নিবন্ধন সনদ যাচাই চলছে, ২৮ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত ১২ বছরে একজন চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে, ১২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। তবে এই স্থগিত সময়ে তারা চিকিৎসাসেবা দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যায়, এমন একটি ঘটনাও পায়নি বিএমডিসি।
ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং আইনগত প্রতিকারের জন্য দেশে একক কোনো আইন কার্যকর নেই। ২০১৬ সালে ‘রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন’ নামে একটি আইন প্রস্তাব করে সরকার। কিন্তু এই আইনটি এখনও কার্যকর হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসকদের আপত্তির কারণে সেটি এখনও পাশ করা সম্ভব হয়নি। যখন আইনটির খসড়া প্রকাশিত হয়, তখন থেকে এর সমালোচনা শুরু হয়েছে। এতে রোগী নয় বরং চিকিৎসকদের সুরক্ষার দিকটিতে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। ভুল চিকিৎসার অভিযোগে রোগীর আত্মীয়দের সঙ্গে চিকিৎসকদের নানা সময়ে যে বিবাদ, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে সেই বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। প্রস্তাবিত আইনের দুটি বিষয় নিয়ে আপত্তি রয়েছে। তা হলো চিকিৎসকের ভুলের অভিযোগ উঠলে চিকিৎসক বা অন্য সেবাদানকারীদের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা যাবে না।
অন্যদিকে কোনো ব্যক্তি স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের প্রতি সহিংস আচরণ করলে এবং প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করলে তা জামিন অযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। এ কারণেই অনেকে মনে করছেন, চিকিৎসক ও প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা নিয়ে আইনটিতে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) স্ট্যান্ডিং রিকগনিশন কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ সময়ের আলোকে বলেন, ‘কোনো চিকিৎসক ইচ্ছা করে কোনো রোগীর মৃত্যু হোক এটি চায় না। চিকিৎসককে ফৌজদারি আইনে গ্রেফতারের বিষয়টি কাম্য নয়। রোগীর স্বজনরা চাইলে বিএমডিসির কাছে প্রতিকার চাইতে পারে।’
নজির সৃষ্টি করেছে, বিএমডিসির এমন কোনো প্রতিকার আছে কি না, জানতে চাইলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক এই মহাসচিব আরও বলেন, ‘রোগীর মৃত্যু হলেই বলা হয়, ভুল চিকিৎসা, অবহেলা। এগুলো সমাজকে বিভ্রান্ত করে। প্রকৃতপক্ষে বিশেষজ্ঞদের তদন্তের মাধ্যমেই তা বের করা সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইনটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে দ্রুত করতে হবে। এতে করে রোগী, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা সম্ভব হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ সেবা ও মানবিকতা ভুলে কেবল বাণিজ্য করছে, যা অনৈতিক। সাধারণ মানুষের কাছে চিকিৎসাসেবার অর্থই কেবল ওষুধ সেবন। ওষুধের চাহিদা বেশি থাকায় দেশের অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো লাখ লাখ ফার্মেসি গড়ে উঠেছে। ফলে জনগণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ সেবন করছে। যা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সসহ জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। তাই যেকোনো মূল্যে ওষুধের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। চিকিৎসকদের আরও মানবিক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।’
শিশু তাহমিদের মৃত্যুর ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর গত বুধবার অভিযান চালিয়ে জেএস ডায়াগনোস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টার বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কোনো অনুমোদন ছিল না বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মোহাম্মদ মইনুল আহসান।
তিনি বলেন, ‘শুধু ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। সেখানে অনুমোদন না নিয়েই তারা হাসপাতাল পরিচালনা করছিল। সে জন্য তাদের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খতনা করার সময় শিশুটির মৃত্যু হয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে তদন্ত করে তা দেখা হবে।’
শিবা/জামান/২৩.০২.২৪