বয়স নিয়ে উদ্বিগ্ন চাকরি প্রার্থীরা
আশরাফুল ইসলাম রানা।।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রাসেল আহমেদ (আসল নাম নয়)। করোনার কারণে গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে অবস্থান করছেন। সনদপত্র অনুযায়ী ৩০ বছর বয়স হতে বাকি আছে দুই মাস। মহামারী করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে সব সরকারি চাকরির পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় এ সময়ের মধ্যে তার চাকরি পাওয়ার সুযোগ প্রায় অনিশ্চিত। বিশ্ববিদ্যালয়টির আরেক ছাত্র সাফায়েত হাসান।
দুই বছর আগে মাস্টার্স শেষ করার পর তিনি অনলাইনে একটি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। গত বছর করোনায় ধাক্কায় সেটি নড়বড়ে হয়ে যায়। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও সেটি পুনরায় অনিশ্চয়তায় পড়েছে। এ অবস্থায় কী করবেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না সাফায়াত। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএসের গবেষণা বলছে, রাসেল-সাফায়াতদের মতো দেশে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি বেকার। করোনা মহামারীর কারণে এ সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার চাকরির বিজ্ঞপ্তি না থাকা ও আগের চাকরির পরীক্ষাগুলোও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত থাকায় শিক্ষিত বেকারদের ভবিষ্যৎ পড়েছে চরম অনিশ্চয়তায়।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত ও মান শক্ত না করেই একের পর এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেকার থাকা সত্ত্বেও অনেক খাতে উচ্চ বেতন দিয়ে বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন নতুন বিভাগ ও অনুষদ খুলছে, কিন্তু সেসব বিভাগ ও অনুষদের কোনো উপযোগিতা আছে কি না দেখা হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বড় একটি নিয়োগের পরীক্ষা ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থা, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তিনটি নিয়োগ পরীক্ষা, তিতাস গ্যাস, সিলেট গ্যাস ফিল্ড, সেতু বিভাগ, পল্লীবিদ্যুৎসহ আরও কয়েকটি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে। এসব নিয়োগ পরীক্ষা কবে অনুষ্ঠিত হবে তা কেউই বলতে পারছেন না।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এই মুহূর্তে পরীক্ষা আয়োজনের সুযোগ নেই। মাত্র আমরা একটু গুছিয়ে নিয়েছিলাম। এর মধ্যেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এলো। সারা দেশে এখন লকডাউন চলছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আমরা নিয়োগ কার্যক্রম আবারও শুরু করব।
দেশের সরকারি নিয়োগ কার্যক্রমের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। পিএসসিও করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে সবধরনের পরীক্ষা ও নিয়োগ বন্ধ রেখেছে। সর্বশেষ ১২ এপ্রিল সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডার চাকরির আবেদন কার্যক্রমও স্থগিত করেছে সরকারি কর্ম কমিশন। এছাড়া ৩১ মার্চ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ১০ গ্রেডের সিনিয়র স্টাফ নার্স ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের ফটো টেকনিশিয়ান পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, করোনাভাইরাস বেড়ে যাওয়ায় জনসমাগম হয় এমন সব নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। পিএসসির জনসংযোগ কর্মকর্তা শারমিন নাহার বলেন, পরীক্ষা ও নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করার আগে তা গণমাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে তরুণদের মধ্যে হতাশা বাড়বে। বৈশ্বিক এ মহামারীর সমস্যয় আক্রান্ত এখন সমগ্র বিশ্ব এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য জনশক্তি তৈরির পাশাপাশি তাদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সর্বশেষ গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সিনিয়র সদস্য ড. শামসুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলে আড়াই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হয়েছে। এর বাইরে বাণিজ্য বড় হয়েছে। তবে এবার জিডিপি কম হলে কর্মসংস্থানও কমতে পারে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদনে ২০৩০ সালে বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১২ কোটি ৯৮ লাখে পৌঁছবে, যা হবে জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ। কিন্তু জনমিতির এ সুফল কাজে লাগাতে হলে প্রত্যেক নাগরিককে যেমন দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, তেমনি তাদের উপযুক্ত কাজের সংস্থান করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক নেহাল করিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, করোনাভাইরাস এখন বৈশ্বিক সমস্যা। লক্ষ করে দেখবেন অনেক রিকশাওয়ালা এখন প্যান্ট পরছেন। এর অর্থ হলো তারা পেশা বদল করেছেন। অনেক শিক্ষিত বেকাররাও এখন এ ধরনের কাজ শুরু করেছেন। এ থেকে মুক্তি পেতে আসলে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। শুধু চাকরির মাধ্যমেই কর্মসংস্থান হয় না। এর জন্য বিদেশি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হয়।