ব্যয় বাড়ল মধ্য ও নিম্নবিত্তের
নিউজ ডেস্ক।।
পরিবহন মালিকদের চাপে অবশেষে গণপরিবহনে ভাড়া বাড়াল সরকার। নতুন ভাড়া অনুযায়ী, দূরপাল্লার বর্তমান বাসভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়েছে। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি যাত্রীকে বাড়তি ৩৮ পয়সা গুনতে হবে। এ ছাড়া বড় বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা, মিনিবাসে ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে পরিবহন মালিকরা খুশি হলেও ব্যয় বাড়ল মধ্য ও নিম্নবিত্তের। এতে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।
জানা গেছে, মহানগরে বাসের বর্তমান ভাড়া কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা, সেটা ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়েছে। কিলোমিটারে ভাড়া বেড়েছে ৪৫ পয়সা। মহানগরে মিনিবাসের বর্তমান ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৬০ পয়সা। সেটি বাড়িয়ে ২ টাকা ৫ পয়সা করা হয়েছে। কিলোমিটারপ্রতি ৪৫ পয়সা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ দূরপাল্লার বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ আর মহানগরে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ ভাড়া বাড়ল। আজ সোমবার থেকেই এ ভাড়া কার্যকর হবে।
তবে সরকার ডিজেলের দাম যে হারে বাড়িয়েছে, বাস ভাড়া তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানো হলেও দূরপাল্লার বাস ভাড়া ২৭ শতাংশ এবং মহানগরে ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
গতকাল রোববার দুপুরে রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রেক্ষাপটে গণপরিবহনে ভাড়া পুনর্নির্ধারণে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে যেসব গাড়ি সিএনজিতে চলে সেসবের ভাড়া বাড়বে না বলে জানিয়েছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার।
এ সময় পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানান, বাসভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে দেশব্যাপী চলমান বাস ধর্মঘট গতকাল সন্ধ্যাতেই প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিনি বলেন, সোমবার (আজ) থেকে নতুন ভাড়া কার্যকর হবে। বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়ে আমাদের নজরদারি থাকবে। আজ (রোববার) থেকেই গাড়ি চলাচল শুরু হবে। ধর্মঘট প্রত্যাহার করে যোগাযোগব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখার আহ্বানও জানান তিনি।
জানা গেছে, মালিকরা ভাড়া পুনর্নির্ধারণের দাবি করলেও ডিজেলের দাম কমানোর বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে কেউ কোনো কথা বলেননি। যে বাসগুলো সিএনজিচালিত সেগুলো কেন মালিকরা বন্ধ রেখেছিল-এমন প্রশ্নের জবাবে এনায়েত উল্লাহ খান বলেন, সিএনজিচালিত বাসের সংখ্যা মাত্র ১/২ শতাংশ। অন্যান্য মালিকরা বন্ধ রাখার কারণে তারাও বন্ধ রেখেছেন। তবে এই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
এদিকে বাসের ভাড়া আরেক দফা বাড়ানোয় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নিম্নমধ্যবিত্ত ও সাধারণ চাকরিজীবীরা। তারা বলছেন, বেতন না বাড়িয়ে সরকার বার বার তেল, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও বাসভাড়া বাড়ানোয় তাদের সংসার চালানো আরো কঠিন করে ফেলছে। কারণ এতে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় আরো বাড়ল।
মিরপুরের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী সোহেল খান বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বার বার বৃদ্ধিতে আমাদের বেহাল দশা। এর মধ্যে বাসভাড়া বাড়ানো আমাদের সাথে তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়।
এদিকে বাংলাদেশ কাভার্ডভ্যান-ট্রাক প্রাইমমুভার পণ্য পরিবহন মালিক অ্যাসোসিয়েশন কর্মবিরতি চলমান রাখার ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল রাজধানীর সাত রাস্তায় নিজেদের কার্যালয়ে এ তথ্য জানান সংগঠনটির অতিরিক্ত মহাসচিব আব্দুল মোতালেব। এ সময় এক সংবাদ সম্মেলনে তিন দফা দাবি তুলে ধরেন কাভার্ডভ্যান-ট্রাক মালিকরা। এগুলো হলো-ডিজেল ও কেরোসিনের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহার, যমুনা ও মুক্তারপুর সেতুর বর্ধিত টোল প্রত্যাহার এবং টোলের নামে দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার চাঁদাবাজি বন্ধ করা। এসব দাবি না মানা পর্যন্ত কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দেন তারা।
সংগঠনটির অতিরিক্ত মহাসচিব আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘জ্বালানি তেলের সঙ্গে সারা দেশের প্রতিটি খাত জড়িত। তেলের দাম বাড়লে সব জায়গায় এর প্রভাব পড়ে। তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয় না। কিন্তু আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত সরকারের। লোকসান দিয়ে গাড়ি চালাব না। তাই আমরা পণ্য পরিবহন বন্ধ রেখেছি। আলোচনার মাধ্যমে আমরা সমস্যার সমাধান করতে চাই।’
জানা গেছে, গতকাল বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত টানা ছয় ঘণ্টা বিআরটিএ চেয়ারম্যান ও পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে যেসব বাস সিএনজিচালিত সেগুলো এই নতুন ভাড়ার তালিকায় পড়বে না। সিএনজি চালিত বাস আগের ভাড়ায় চলবে। তিনি জানান, এই ভাড়া সোমবার (আজ) থেকে কার্যকর হবে। রাতেই এ সংক্রান্ত গেজেট প্রস্তুত করা হবে এবং আজ প্রকাশ করা হবে।
বৈঠকে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার, পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতা খন্দকার এনায়েতউল্লাহ, শ্যামলী পরিবহনের মালিক রমেশ ঘোষ, সোহাগ পরিবহনের মালিক ফারুক তালুকদার, কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দুই প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামে ঊর্ধ্বগতির কারণে ডিজেল-কেরোসিনের দাম পুনর্নির্ধারণ করে সরকার। গত ৩ নভেম্বর রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। নতুন দাম ভোক্তা পর্যায়ে ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছে, যা বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হয়।
কিন্তু ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানোয় পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এরপর গত শুক্রবার ভোর ৬টা থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন বন্ধ করে দেয় মালিকরা। এতে সারা দেশে দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে সাধারণ মানুষ।
ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর থেকেই পরিবহন মালিক ও সংশ্লিষ্টরা বলছিলেন, দাম না কমানো হলে গণপরিবহনসহ অন্যান্য পরিবহনের ভাড়া সমন্বয় করতে হবে। এদিকে ভোগান্তিতে পড়া সাধারণ মানুষ বলছে, বাসের ভাড়া নির্ধারণের দায়িত্ব সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। মালিকরা ভাড়া বাড়াতে পরিবহন বন্ধ করে দিয়ে জনগণকে জিম্মি করলেও সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ভাড়া বাড়াতে চাপ তৈরির কৌশল হিসেবেই পরিবহন সিন্ডিকেট ধর্মঘট করেছে।
এরই মধ্যে গত শুক্রবার দুপুরে নিজ বাসভবনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনায় নিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আহ্বানে গত দুদিনেও সাড়া মেলেনি। ওইদিন ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, রোববার ভাড়া পুনর্নির্ধারণ কমিটির সঙ্গে বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে ভাড়া সমন্বয় করে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ যতটা সম্ভব সহনীয় রাখার চেষ্টা করা হবে।