বৈষম্যের শিকার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা
নিজামুল হক।।
দেশে সাধারণ শিক্ষায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ আছে ৬৫ হাজার ৫৬৫টি প্রতিষ্ঠানে। যেগুলো সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোনো বেতন-ভাতা ছাড়াই শিক্ষার্থীরা এখানে পাঠ গ্রহণের সুযোগ পায়। আর শিক্ষকরা সরকারি ১১ ও ১৩ গ্রেড অনুযায়ী প্রতি মাসে বেতন, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ সব ধরনের সুবিধা পান।
অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষায় একই শ্রেণিতে পড়ার সুযোগ আছে এমন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার সংখ্যা ৮ হাজার ৯৭২টি। প্রতিটি মাদ্রাসায় পাঁচ জন হিসাবে শিক্ষক আছেন ৪৪ হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে মাত্র ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসার সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষক নামকাওয়াস্তে অনুদান পান। আর বাকি ৪০ হাজার শিক্ষক বছরের পর বছর বিনা বেতনে পাঠদানে নিয়োজিত আছেন।
৩৯ বছর ধরে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষার এই বৈষম্য চলছে। সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে শিক্ষা প্রশাসনের উদাসীনতায় এভাবে অমানবিকভাবে রয়েছেন এই স্তরের শিক্ষকরা। তারা দাবি আদায়ে বিভিন্ন সময়ে মাঠে নামলেও কোনো লাভ হয়নি। শিক্ষকরা বলছেন, মূলত মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাথমিক স্তর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় না নেওয়ার কারণেই বিপাকে পড়ছে। সাধারণ শিক্ষার প্রাথমিক স্তর যখন রেজিস্ট্রেশন হয়, তখন ইবতেদায়ি মাদ্রাসাও রেজিস্ট্রেশন হয়। ২০০৩ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বতন্ত্র হিসাবে যাত্রা করলেও তারা মাদ্রাসার এই স্তরটিকে নিতে আগ্রহ দেখায়নি। এ কারণে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে যায়। আর পদে পদে বঞ্চিত হতে থাকে।
বর্তমানে সাধারণ শিক্ষায় প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা চাকরির শুরুতেই ১১তম গ্রেডে ১৯ হাজার টাকারও বেশি বেতন-ভাতা, বাড়িভাড়া পান। রয়েছে উৎসব ভাতাসহ সব সুবিধা। এছাড়া ৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে তাদের। আর সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে শুরুতেই ১৭ হাজার ৫০০ টাকা বেতন, বাড়িভাড়া পান। উৎসব ভাতা ও বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধিত আছেই।
অন্যদিকে ৭ হাজার ৪৫৩টি ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা কোনো বেতন-ভাতা বা আর্থিক কোনো অনুদান পান না। ধর্মের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তারা এই পাঠদান করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক মাদ্রাসার শিক্ষকরা। ১৯৯৪ সালে মাত্র ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসার শিক্ষকদের সরকারি অনুদান দেওয়া শুরু হয়। এদের মধ্যে বর্তমানে প্রধান শিক্ষক পান সর্বসাকুল্যে মাসে ২ হাজার ৫০০ টাকা। আর সহকারী শিক্ষকরা পান ২ হাজার ৩০০ টাকা। বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির কোনো সুযোগও নেই। অনুদান বৃদ্ধির ফলে ২০১৭ সাল থেকে এই সুবিধা পান তারা। আগে দেওয়া হতো মাত্র ৫০০ টাকা করে। পরে ২০১২ সালে এই অনুদান বৃদ্ধি করে দেওয়া হয় ১২০০ টাকা। এখন দ্বিগুণ বৃদ্ধির পরও ২ হাজার ৩০০ টাকা।
স্বাধীনতা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক পরিষদের সভাপতি এস এম জয়নাল আবেদীন বলেন, এভাবে আর কতদিন না খেয়ে পাঠদান করে যাব? অনেকে বেতন-ভাতা বা সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা না পেয়েই ইতিমধ্যে মারা গেছেন। সাধারণ শিক্ষা সরকারি হলেও আমরা কেন বেসরকারি থাকব। ক্ষোভ ও বঞ্চনার মধ্য দিয়ে সবার প্রতিটি দিন যাচ্ছে। আমাদের প্রধান দাবি জাতীয়করণ। দ্রুত সময়ে জাতীয়করণ না হলেও অন্তত এমপিওভুক্ত করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।
তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে বর্তমান সরকার দেশের প্রায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করে। এর মধ্যে বেসরকারি, রেজিস্ট্রেশনকৃত ও কমিউনিটি বিদ্যালয়ও ছিল। তখন স্বাভাবিকভাবে ইবতেদায়ি জাতীয়করণ হওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি। প্রধান কারণ, এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল। যেগুলো হয়েছে, তা ছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে।
ঐ সময় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলেন নজরুল ইসলাম খান। গতকাল তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, অবশ্যই একই সঙ্গে সাধারণ ও মাদ্রাসা উভয়ের জাতীয়করণ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তখন ইবতেদায়ি স্তরের কোনো নেতৃত্ব গড়ে উঠেনি, যারা বিষয়টি নিয়ে সামনে আসবেন। সরকারের সামনে তাদের দাবির বিষয়টি তুলে ধরবেন। এছাড়া সাধারণ শিক্ষার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণের জন্য যে সময় যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা হয়তো চাননি মাদ্রাসার প্রাথমিক স্তর জাতীয়করণ হোক।
তবে ইবতেদায়ী মাদ্রাসার বেশির ভাগ শিক্ষকই মনে করেন, এই স্তর যদি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকত তাহলে জাতীয়করণ সহজ হতো। এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, এটি মাদ্রাসা বিভাগ দেখবে। সরকার যদি চায় মাদ্রাসা ইবতেদায়ি স্তরটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দেখবে। তাহলে সেটাই হবে। এক্ষেত্রে সব সিদ্ধান্তই সরকারের।
তথ্য অনুযায়ী, এ দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাথমিক স্তর ফোরকানিয়া ইবতেদায়ি মাদ্রাসা নামে পরিচালিত হয়ে আসত। এসব মাদ্রাসাসহ আরো নতুন নতুন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা সৃষ্টি করে ১৯৮৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে মঞ্জুরি প্রদান শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে তৎকালীন সরকার বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত প্রতিটি মাদ্রাসায় এককালীন ৪ হাজার ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭ হাজার টাকা প্রদান করে। তবে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়নি।
প্রসঙ্গত, দেশে আলিম, ফাজিল ও কামিল স্তরের ৮ হাজার ২২৯টি মাদ্রাসা রয়েছে। এই মাদ্রাসার সঙ্গে যেসব ইবতেদায়ি শিক্ষকরা সংযুক্ত আছেন তারাও অন্যান্য স্তরের মতো এমপিওভুক্ত। তারা মূল বেতন, ১ হাজার টাকা বাড়িভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। কিন্তু স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের ভাগ্যে এসব সুযোগ-সুবিধা জোটেনি।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৩/০৫/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়