বৈশ্বিক শিক্ষা সংকট আসলে একটি শিক্ষণ সংকট
ড. শফিকুল ইসলামঃ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তীর্থস্থান হলো বিশ্ববিদ্যালয়। অধিকাংশ মেধাবী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে থাকে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথা সার্বিক উন্নয়নের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গত কয়েক বছর বর্তমান সরকারের আমলে উচ্চশিক্ষায় অনেক উন্নয়ন এবং ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। যা মানুষের কাছে প্রশংসনীয়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি ভালোভাবে গড়ে ওঠে, তাতে দেশের সার্বিক কল্যাণ সাধিত হয়। একজন ব্যক্তি বা ছাত্র উচ্চশিক্ষা বেছে নেয় যখন সে তার অধ্যয়ন প্রবাহে বিশেষীকরণ করতে চায়।
একটি সমৃদ্ধ কর্মজীবন, আর্থিক নিরাপত্তা এবং নিজের উন্নতি উচ্চশিক্ষার সুবিধা। উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বা ছাত্রছাত্রী বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে আরও বেশি নিয়োগযোগ্য হয়ে ওঠে এবং সম্ভবত একটি সুখী ও চাপমুক্ত জীবনযাপন করতে পারে। উচ্চশিক্ষিত নাগরিকরা কমিউনিটি বিল্ডিং কার্যকলাপে আরও বেশি জড়িত থাকে এবং তাদের শৃঙ্খলা ও কৃতিত্বের বোধ বেশি থাকে। তারা সমাজের প্রতি বেশি জবাবদিহিতা প্রকাশ করে। নেপোলিয়ন বলেছিলেন, আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাকে একটি শিক্ষিত জাতি দেব। নেপোলিয়নের বাণীটি সর্বদা চিরন্তন সত্য। একটি জাতি বা দেশ গঠনে শিক্ষিত নারীর ভূমিকা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। আর এই শিক্ষিত নারী তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অপরিসীম এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
আর ছাত্রছাত্রীদের উন্নতিকরণ বা তাদের মেধা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। কিন্তু সেই শিক্ষক নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা, বিতর্ক বহমান। প্রায়ই গণমাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের খবর দেখতে বা শুনতে পাই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন আবেদনকারীকে বাদ দিয়ে কম মেধাবীকে নিয়োগ দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এমন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করিয়েছেন। এ ছাড়া নিজের পিএইচডি ডিগ্রির শিরোনামের ইংরেজি বলতে পারেনি তাকে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। যা খুবই দুঃখজনক। এসব কেন ঘটে তা আমরা সবাই জানি। অর্থাৎ তদবির বা অন্য কোনো সুপারিশের কারণে এ ধরনের বাজে সংস্কৃতি শিক্ষক নিয়োগে দেখা যায়। এসব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনেকবার তদন্ত করেছে। কিন্তু তার পরও এসব বন্ধ হচ্ছে না।
শিক্ষকরা উপাচার্য হয়ে গেলেই তার মনমতো প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে থাকেন। এই নিয়ে সম্প্রতি অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে সংবাদপত্রে নেতিবাচক খবর প্রকাশ পায়। যা একজন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষক হয়ে খুব কষ্ট পাই। এসব বন্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। অন্যথায় উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় সংকট দেখা দিতে পারে। সরকারের নেওয়া নানামুখী পদক্ষেপ যেখানে শিক্ষাকে উন্নয়ন ঘটাবে, তা এখন অস্বচ্ছ শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে বিঘœ ঘটতে পারে। তাই এ পরিস্থিতি থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে হবে।
বর্তমানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শুধু মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকে। যেখানে নানা ধরনের অনিয়ম হতে পারে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগের কথা উল্লেখ করি, যেখানে এক আবেদনকারী লিখিত পরীক্ষায় ষষ্ঠ বা সপ্তম হয়েছে, কিন্তু সে ভাইভায় বেশি মার্ক পাওয়ায় নিয়োগ বোর্ড তাকে নিয়োগের সুপারিশ করে। কিন্তু এটা কতটুকু যৌক্তিক। যদিও পরে সিন্ডিকেট ওই নিয়োগটি বাতিল করে দেয়। যদি বাতিল না হতো! তা হলে ভাবুন তো কী হতো! তাই শিক্ষক নিয়োগে একটি স্বচ্ছ নিয়ম থাকা দরকার। শিক্ষক নিয়োগ শতভাগ সঠিক করার জন্য একটি কাজ করা যেতে পারে। যেমন, মেধা তালিকায় যারা ১-৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে, একমাত্র তারাই শিক্ষক পদের জন্য আবেদন করতে পারবে। যার মানে কোনো ব্যাচে ১০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে, তা হলে ১ থেকে মেধাক্রম ৫ পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবেদনের যোগ্য। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে লবিং থাকবে না বললেই চলে। এ রকম নীতিমালা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে। যেখানে শিক্ষক নিয়োগের জন্য মেধা তালিকায় শতকরা প্রথম থেকে সপ্তম স্থানে থাকতে হবে।
এ ছাড়া পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সুন্দর নিয়ম চালু রয়েছে। যেখানে যত আবেদন জমা হবে, তার মধ্য থেকে প্রথম ১০ জন আবেদনকারীকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। প্রথম ১০ জনের যে কেউ শিক্ষক হতে পারবে। অর্থাৎ এর কারণে শিক্ষক নিয়োগে লবিং কমে যাবে। ভালো শিক্ষার্থীরা শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ পাবে। কারণ তখন শিক্ষার্থীরা জানবে যে লবিং করার দরকার নেই। এজন্য সরকারকে দ্রুত সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করে দিতে হবে। যেমন, চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে অবশ্যই পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে।
ভারতে শিক্ষক হতে হলে পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে। তবে মাস্টার্স ডিগ্রি করে শিক্ষক হতে পারবে কিন্তু তাকে ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট পরীক্ষায় উন্নীত হয়ে ৫৫% মার্ক পাইতে হবে। তা হলে শিক্ষক পদের জন্য আবেদন করতে পারবে। এমনকি মালয়েশিয়া এবং জাপানে শিক্ষক হতে হলে পিএইচডি ডিগ্রি থাকাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। অধিকাংশ শিক্ষকই পিএইচডি ডিগ্রির অধিকারী জাপান, মালয়েশিয়া এবং ভারতে। এসব দেশে গবেষণাকে শিক্ষক নিয়োগে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। অধিকাংশ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে ডেমো ক্লাস নিয়ে থাকে। শুধু মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক। সেই প্রশ্ন আমি কর্তৃপক্ষের কাছে রাখলাম। তাই শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে কয়েকটা প্যারামিটার নির্বাচিত করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া উচিত। তা হলে উচ্চশিক্ষার মানের উন্নতি ঘটবে বলে বিশ্বাস করি।
তাই শিক্ষক নিয়োগে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বা পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আইন চালু করা জরুরি। ভবিষ্যতে ভারত বা চীনের মতো নিয়ম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা একান্ত প্রয়োজন। এটা চালু করতে হলে মিনিনাম ৩ বা ৪ বছর হাতে রেখে এই আইন শুরু করা জরুরি। কারণ পিএইচডি ডিগ্রি করার জন্য কমপক্ষে তিন বছর সময় একান্ত প্রয়োজন। শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া বন্ধে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ ছাড়া উন্নয়নকে টেকসই করা কঠিন হয়ে পড়বে। উচ্চশিক্ষার উন্নয়নের জন্য প্রথম এবং পূর্বশর্ত হলো যোগ্য এবং ভালো মানের শিক্ষক নেওয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
বৈশ্বিক শিক্ষা সংকট আসলে একটি শিক্ষণ সংকট। শিক্ষার্থীদের শেখার ফলাফলের উন্নতিতে শিক্ষকদের গুণমান সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশগুলো দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষকতার ক্যারিয়ারের জন্য সেরা প্রার্থীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষক নিয়োগে একটি স্বচ্ছ নীতিমালা থাকা দরকার। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সর্বোত্তম অনুশীলনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষক উন্নয়ন কর্মসূচি নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। শিক্ষক, প্রশিক্ষক, শিক্ষাবিদ এবং সুপারভাইজার হওয়ার জন্য সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষকদের স্ক্রিনিং, প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ দেওয়ার ওপরও আরও জোর দেওয়া উচিত। তাদের একটি খুব বিস্তৃত শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা, গভীর বিষয়ে জ্ঞান এবং কার্যকর শিক্ষাগত অনুশীলনের দক্ষতা এবং বোঝার প্রদর্শন করা উচিত। এসব কাজের সফলতার জন্য গুণগত শিক্ষক নিয়োগ বাঞ্ছনীয়।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ