বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এ কি দশা!
নিজস্ব প্রতিবেদক ।।
করোনাভাইরাসের অভিঘাতে রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে অনেক পরিবার। এর প্রতিফলন দেখা গেছে রাজধানীর সাধারণ মানের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। নতুন বছরে সেগুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে খুবই কম। গত বছরের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় থাকা এসব বেসরকারি স্কুলের জন্য এটি আরেকটি বড় ধাক্কা হয়ে দেখা দিয়েছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এসব পরিবারের ছেলেমেয়ের লেখাপড়া যাতে ক্ষতি না হয়, সে ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। আগেই ধারণা করা হয়েছিল, করোনায় একটা বড়সংখ্যক ছেলেমেয়ে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়তে পারে।
সরকারি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা শহর-গ্রামে যেখানেই থাকুক, তারা লেখাপড়া থেকে যেন বঞ্চিত না হয় সে জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঝরেপড়া রোধ করতে সরকার আগেও নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের। এখন এর সঙ্গে বাড়তি কিছু করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
রাজধানীর সূত্রাপুরে বেসরকারি একটি নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লিটল স্টার স্কুল। গত বছর এ প্রতিষ্ঠানে ৪শর বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। এবার মাত্র ৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে স্কুলটিতে। স্কুলের সহকারী শিক্ষক তামান্না মজুমদার জানান, অনেক অভিভাবক এলাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। পুরনো শিক্ষার্থীরা তো আসেই না। নতুন শিক্ষার্থীও কমে গেছে। তিনি বলেন, করোনায় আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন ভাড়া, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়ে প্রায় ১ কোটি টাকা ঋণ হয়ে গেছে। এখন যদি কাক্সিক্ষতসংখ্যক শিক্ষার্থী না পাওয়া যায়, প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই।
জুরাইন রেলগেট এলাকার মাস্টারমাইন্ড কেজি স্কুলের উদ্যোক্তা সোহরাব হোসেন জানান, মাত্র পাঁচ বছরেই তার স্কুলটি এলাকায় বেশ সুনাম অর্জন করেছে। প্রতিবছর এখানে শিশুদের ভর্তির জন্য অনেক ভিড় জমে। এবার ভিড় দূরের কথা, খোঁজ করেও শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য এ স্কুলটি বেশ জনপ্রিয়। করোনায় বন্ধের সময় অনেক পরিবার গ্রামে চলে গেছে। আবার কেউ কেউ দেখি তাদের সন্তানদের সরকারি স্কুলে দিয়েছে। কারণ বেসরকারি স্কুলের চেয়ে সরকারি স্কুলে খরচ কম। করোনায় আর্থিক সংকটের কারণেও স্কুলে আসছে না অনেক শিশুর পরিবার।
কোতোয়ালি এলাকার কিন্ডারগার্টেন ক্ষুদে প-িতের পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক জোহরা চৌধুরী জানান, এ বছরের মতো এত কমসংখ্যক শিক্ষার্থী তাদের কখনই ছিল না। সর্বনিম্ন ছিল ২০১৪ সালে, কারণ আগের বছর একটা রাজনৈতিক সহিংসতা ছিল। তা-ও প্রায় দেড়শ শিশু ভর্তি হয়েছিল প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম শ্রেণিতে। তিনি বলেন, গত নভেম্বর থেকে ভর্তির প্রচার করে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত মাত্র ২৮ শিশু ভর্তি হয়েছে। আগে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ছিল সাড়ে ৩০০। এখন পুরনো শিক্ষার্থী এসেছে ৫০ থেকে ৬০ জন। দুই শিফটে স্কুলটি পরিচালনা করা হচ্ছে জানিয়ে জোহরা চৌধুরী বলেন, ১০ জন শিক্ষক আর দুজন কর্মকর্তা এবং চারজন অফিস সহকারী আছেন। করোনার সময় স্কুলের আয় না থাকলেও নিয়মিত ভবন ভাড়া দিতে হয়েছে। শিক্ষকদের বেতন প্রথম কয়েক মাস দিয়েছেন। এর পর অনেক বকেয়া আছে। তিনজন চাকরি ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
এমন চিত্র রাজধানীর সাধারণ বেসরকারি কিন্ডারগার্ডেন, নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয়। এর বাইরে স্বনামধন্য কিছু বেসরকারি স্কুলেও পুরনো শিক্ষার্থী কমছে। তবে নতুন শিক্ষার্থী আশানুরূপ ভর্তি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে বুয়েটের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, করোনা সংক্রমণে বিশ্বের সব খাতে বড় ধরনের একটা নাড়া দিয়েছে। তার মধ্যে শিক্ষা খাত অন্যতম। আমাদের দেশেও ব্যতিক্রম নয়। মানুষের আয়রোজগার কমে গেছে। ব্যবসা বন্ধ হয়েছে বা কমেছে। কর্ম হারিয়েছে অনেক মানুষ। এ কারণে শহর থেকে পরিবারগুলো গ্রামে চলে গেছে। এটি এক ধরনের বাস্তুচ্যুতি। এই বাস্তুচ্যুত সাধারণ প্রাকৃতিক ঝড়, বন্যা, নদীভাঙনের কারণেই বেশি হয়। সেটি ভিন্ন রূপে ঘটেছে আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ মহামারীতে। এ কারণে বাস্তুচ্যুত পরিবারের শিশুরা আগের স্কুলে ফিরছে না। তবে শিশুরা শহরে থাকুক আর গ্রামে থাকুক, তারা এ দেশেই আছে। সুতরাং তাদের ঝরেপড়ার একটা আশঙ্কা আমরা আগেই করেছি। সরকার তাদের লেখাপড়ায় যুক্ত রাখতে নিশ্চয় কোনো পরিকল্পনা নিয়েছে। না নিলেও তা দ্রুত নিতে হবে। কারণ এখন নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, করোনায় যেসব পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তাদের শিশুদের নিজ এলাকায় সরকারি স্কুলে ভর্তি নেওয়ার নির্দেশনা আগেই দিয়েছি। এ ক্ষেত্রে ওই শিক্ষার্থীর আগের শ্রেণির যে কোনো ডকুমেন্ট দেখালেই চলবে। আর্থিক সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া হার কমিয়ে আনতে আমরা বৃত্তি, উপবৃত্তি এবং জামাকাপড় কেনার জন্য সহায়তা দিচ্ছি। পাশাপাশি স্কুলের যে মিড-ডে মিল বিস্কুট দেওয়া হতো, সেটি এখন বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর তারা স্কুলেই একবেলা খেতে পারবে। বেসরকারি স্কুলে খরচ বেশি। অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান- আপনার সন্তানকে স্থানীয় সরকারি স্কুলে ভর্তি করান।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীর বৃত্তি, উপবৃত্তি চালু রয়েছে। কারিগরি শিক্ষার্থীদেরও আগের সব সুযোগ-সুবিধা পাবে, সঙ্গে বাড়তি কিছু করারও চেষ্টা করছে সরকার। মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সরকারের বিশেষ ভাতা পাবেন। এ জন্য যোগ্য প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন চাওয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ এ আবেদন চেয়েছে। আগ্রহী প্রার্থীরা ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবেদন করতে পারবেন। গত ৫ জানুয়ারি কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।