বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি
মাছুম বিল্লাহ।।
বহুল আলোচিত নতুন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার প্রস্তাব অবশেষে চূড়ান্ত করেছে মন্ত্রণালয়। এতে মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে মোট এক হাজার ৭৬৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৮৬৫ কোটি টাকা। এক হাজার ৭৬৭টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হলে তাতে ব্যয় হবে ৭৯৬ কোটি ৪৬ লাখ ৪৩ হাজার টাকা।
বাকি ৬৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনকালে আরো কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। যে এক হাজার ৭৬৭টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে এমপিওভুক্তির সব শর্ত পূরণ করে বাছাইয়ে টিকেছে এক হাজার ৬৪৯টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বুয়েটের তৈরি করা বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছে।
এমপিওভুক্তির নীতিমালা-২০১৮-র ১৪ ধারা অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠান সব শর্ত পূরণ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান বাছাই করার পর দেখা যায়, সারা দেশের ৮৯টি উপজেলার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্তির যোগ্যতা পূরণ করতে পারেনি। সমতার স্বার্থে এসব উপজেলায় এমপিওভুক্তির নীতিমালার ২২ নম্বর ধারা প্রয়োগ করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। সেখানে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষায় অনগ্রসর, ভৌগোলিকভাবে অসুবিধাজনক, পাহাড়ি, হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল, নারী শিক্ষা, সামাজিকভাবে অনগ্রসর গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় শর্ত শিথিল করা যেতে পারে।’
সর্বশেষ ২০১০ সালের জুন মাসে এক হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু সরকার এমপিও দিতে পারেনি। নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৮ সালের ১২ জুন। ওই দিন এমপিওবিহীন বেসরকারি স্কুল-কলেজ এমপিওভুক্তকরণের নীতিমালা এবং জনবল কাঠামো জারি করা হয়। এরপর একে একে মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রকাশ করা হয়।
২০১৯-২০ নীতিমালার এ ধারা প্রয়োগ করে ৮৯টি উপজেলার মধ্যে এমপিওভুক্তির শর্ত পূরণে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য হিসেবে বাছাই করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মানদণ্ড হিসেবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ন্যূনতম ১০০ জন এবং কমপক্ষে দুই বছরের স্বীকৃতি থাকার বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বাদ পড়া প্রতিটি উপজেলা বা থানা থেকে একটি প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হয়েছে। এই মানদণ্ডে ৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছে।
বিশেষ বিবেচনায় বাছাই করা হয়েছে কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী উপজেলার ছিটমহলের একমাত্র স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘মইদাম কলেজ’, যার শিক্ষার্থী সংখ্যা ৮৫। ২২ ধারা প্রয়োগ করে মোট ৬১টি প্রতিষ্ঠানকে তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেশের দুর্গম ও পার্বত্য এলাকা, পাহাড়ি, হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় নীতিমালার ১৪ ধারা অনুসারে এমপিওভুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি।
এমন ৫৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৫০০ জন বা তার বেশি এবং কমপক্ষে দুই বছরের স্বীকৃতি থাকার শর্ত পূরণ করতে হয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাদ পড়া ৮৯টি উপজেলায় ২২ ধারা প্রয়োগ করে ৬১টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার পরও ২৯টি উপজেলা বা থানা বাদ থেকে যায়, যেগুলোর মধ্যে উপজেলা ১২টি ও থানা ১৭টি। এই ১২টি উপজেলার সাতটি থেকে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছে। যোগ্য না হওয়ায় অন্য পাঁচটি উপজেলার কোনো প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে দেশের ২৩টি উপজেলা বা থানা এলাকা থেকে এমপিওভুক্তির জন্য এ বছর কোনো আবেদনই পাওয়া যায়নি। দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার (নিম্নমাধ্যমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি) ৯৭ শতাংশ বেসরকারি ব্যবস্থাপনানির্ভর। এ স্তরে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় এক হাজার, এমপিওভুক্ত ২৮ হাজারের বেশি, আর স্বীকৃতি আছে কিন্তু এমপিও নেই এমন প্রতিষ্ঠান আছে সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো, আর স্বীকৃতিবিহীন আছে কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছুটা আর্থিক সক্ষমতা থাকলেও সম্পূর্ণ নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দৈন্যদশার ভেতর রয়েছে। যে কারণে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার দিক দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পিছিয়ে পড়েছে।
সরকারি, এমপিওভুক্ত এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নির্বিশেষে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একই নিয়ম-নীতিতে পরিচালিত হয়। একই কারিকুলাম, সিলেবাস এবং প্রশ্নপদ্ধতি অনুসরণ করে। শিক্ষার্থীরা বোর্ড থেকে একই মানের সনদ লাভ করে। অথচ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ও স্বীকৃতিবিহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি বেতন-ভাতাদির কিছুই পায় না। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এর শিক্ষক-কর্মচারীরা এক অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন কাটায়। তাদের এই অনিশ্চয়তা হাজার হাজার, এমনকি লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষার ভীত তৈরিতে মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে।
এমপিওবঞ্চিত হলে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে টিকে থাকা দুরূহ হয়ে পড়বে। শহর এলাকায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতনপ্রাপ্ত কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়তো কোনোভাবে টিকে থাকবে। তবে মফস্বলের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আমি নিজে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘুরে ঘুরে দেখেছি যে তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো বেতন নেয় না। শুধু এমপিওর টাকার ওপর নির্ভরশীল।
আর যেসব প্রতিষ্ঠান এমপিভুক্তির বাইরে থাকবে তাদের অবস্থা আরো খারাপ। প্রস্তাবিত এমপিও নীতিমালা ২(খ) ধারায় বর্তমানে অনুমোদিত সব স্কুল-কলেজ ভৌগোলিক দূরত্বভিত্তিক ম্যাপিং এবং ভৌগোলিক দূরত্বে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলে তা প্রশাসনিকভাবে একীভূত করার বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একাধিক স্কুল ভবন-কাঠামো একীভূত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস হিসেবে বিবেচিত হবে। নীতিমালার ১২ ধারায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলির প্রস্তাব করা হয়েছে। বদলির মাধ্যমেও অতিরিক্ত বিবেচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের অন্য প্রতিষ্ঠানে সমন্বয় করা সম্ভব।
তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি থাকবে অথচ এমপিও হবে না, এটিকে সুবিবেচনাসম্মত সিদ্ধান্ত বলা যাবে না। স্বীকৃতির শর্তাবলি সঠিকভাবে অনুসরণ করলে কোনো অযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি থাকার কথা নয়। ঠিকভাবে না চলায় সম্প্রতি ২২০টি মাদরাসার স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে। কোনো জনপদে স্থাপিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিকে থাকবে এলাকাবাসী সেটি প্রত্যাশা করে। বহু বছর অপেক্ষার পরও এমপিভুক্ত না হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে পড়ে, আর সেখান থেকে আমরা মানসম্মত শিক্ষা কোনোভাবেই আশা করতে পারি না।
তাই অনেকেই মনে করেন যে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্ত করা হলে প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়বে, আর শিক্ষক-কর্মচারীরা শিক্ষাদানে ও শিক্ষাদানের সঠিক পরিবেশ সৃষ্টিতে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে এটিও ঠিক যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মোট বরাদ্দের ৬৫ শতাংশই ব্যয় হয় এমপিওর জন্য। মানসম্পন্ন শিক্ষার কথাও যেমন ভাবতে হবে, তেমনি ভাবতে হবে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো ধরনের সরকারি সহায়তা ছাড়াও শিক্ষাদান করে যাচ্ছে তাদের কী হবে? রাষ্ট্রীয় ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায় কর্মরত শিক্ষক, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের নয়। বিষয়টি আমাদের যৌক্তিকভাবে ভাবতে হবে।
লেখক : বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেল্টা), সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক