বুক ভরা আর্তনাদে কাটলো সরকারিকৃত স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের ঈদ!
।। মো. শরীফ উদ্দিন আহমেদ।।
মো. ইয়াছিন খান নামের একজন সদ্য সরকারি কলেজের শিক্ষক "সরকারি কলেজ নন এমপিও শিক্ষক ফোরাম" নামক ফেসবুক গ্রুপে গত ২৬ জুন আক্ষেপ করে লিখেন, "আহ! সরকারি শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন আর কতদূর! এই ঈদেও পরিবারের কারও জন্য ১ পয়সারও কোনো কিছু খরিদ করতে পারলাম না অথচ আমি একজন সরকারি কলেজের প্রভাষক! বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান, ছোট ভাই, ছোট বোন সকলের নিকট আমি চরম অসহায়। মাঝে মাঝে মনে চায় এই জীবনটি আর এই দুনিয়ায় রাখবোনা, নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দেই। দেশবাসী জানুক আমি কী কারণে এমন করলাম।
সরকারি হওয়ার প্রজ্ঞাপনের সাথে সাথেই কলেজ থেকে কিছু টাকা বেতন দিত সেটি বন্ধ করে দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। কবে নিজের বেতনের টাকা দিয়ে কিছু ক্রয় করবো, আল্লাহই ভালো জানেন। শিক্ষক নেতা স্যারদের নিকট আকুল আবেদন আপনারা আমাদের ননএমপিও দের জন্য কিছু একটা করুন যাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের কাজটি একটু তাড়াতাড়ি করে আবার সচিব কমিটিতে পাঠায় এবং মাহবুব স্যার (মন্ত্রী পরিষদ সচিব) যেন অনুমোদন প্রদান করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও যেন আমাদের প্রতি একটু আন্তরিক ও মানবিক হন। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।"
ইয়াছিন খানের কর্মরত কলেজটি সরকারি হয় ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট থেকে। ২০১৬ সালে এটি সরকারিকরণের প্রক্রিয়ায় আসে। কলেজ সরকারি হলেও শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্তীকরণের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় তিনি এখনও বেসরকারি। কলেজের নিজস্ব তহবিল থেকে আগে যতসামান্য ভাতা পেলেও সরকারি হওয়ার পর থেকে তা-ও বন্ধ রয়েছে। এরইমধ্যে তিনবার যাচাই-বাছাই শেষে তার ফাইল শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেরিয়ে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির অনুমোদনের জন্য সভায় উঠে। সেখান থেকে অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের নামে আটকে দেওয়া হয় অন্যান্যদের ফাইলের সাথে তার ফাইলও। একদিকে বেতন-ভাতা-তো নেই-ই আরেকদিকে নিয়োগের কাজ অদৃশ্য কারণে আটকে থাকায় এক বিপর্যস্ত জীবন তার। এই ঈদেও যে হাসি ফোটানো গেলনা পরিবারের তার আক্ষেপ থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট!
জনাব গোলাম মোস্তফা সরকারিকৃত একটি কলেজের ৭ম গ্রেডের একজন শিক্ষক। তার আত্তীকরণের কাজ সম্পন্ন হওয়ায় বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন ২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে। বেসরকারি অবস্থায় তিনি ৭ম গ্রেডের শিক্ষক হলেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৯ম গ্রেড-এ। সরকারি নিয়োগের পূর্বে বেসিক ২৯ হাজার টাকার সাথে পাঁচটি ইনক্রিমেন্টসহ মূলবেতন ছিল ৩৭ হাজার ৩০ টাকা। এর সাথে ৩৫ শতাংশ বাড়িভাড়া এবং ১ হাজার পাঁচশত টাকা মেডিকেল ভাতাসহ সর্বসাকুল্যে পাওয়ার কথা ৫১ হাজার চারশত ৯১ টাকা। কিন্তু সরকারি হওয়ার পর তিনি পাচ্ছেন ২২ হাজার টাকা স্কেলে ৪টি ইনক্রিমেন্টসহ সর্বসাকুল্যে ৩৮ হাজার নয়শত ৬৪ টাকা।
প্রতি মাসে বেসরকারি থেকে সরকারি হওয়ার পর কম পাচ্ছেন ১২ হাজার পাঁচশত ২৭ টাকা। ২০২২-২৩ অর্বথছরে কম পাবেন ১ লক্ষ ৫০ হাজার তিনশত ২৪ টাকা। বছর যত যাবে বৈষম্যের পরিমাণ ততই বাড়তে থাকবে। পেনসনে ক্ষতির পরিমাণ হবে বিশাল আকারের। স্বপ্নের সরকারিকরণ তার কাছে এখন গলার কাটা।বেসরকারি আমলে যে বেতন-ভাতা দিয়ে তিনি সংসার চালাতেন এখন সরকারি হয়ে আগের চেয়ে কম বেতনে সংসার চালাতে গিয়ে কুরবানির ঈদে হিমসিম খেতে হয়েছে তাকে।
এ চিত্র বাংলাদেশের প্রায় সকল সরকারিকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের । সদ্য সরকারিকৃত মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষক যারা টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পেয়ে ৯ম গ্রেড-এ ২২ হাজার টাকা স্কেলে বেতন পেতেন তাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে ১০ম গ্রেডে এবং বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ হাজার টাকা স্কেল-এ। সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদের ক্ষেত্রেও অবনমন হয়েছে। শিক্ষকদের প্রশ্ন, বেতন যদি কমেই যায় তাহলে বেসরকারি থেকে সরকারি হয়ে লাভ কী? কি দরকার ছিল এই সরকারিকরণের?
২০১৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে শুরু হয় প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মাধ্যমিক স্কুল ও একটি করে কলেজ সরকারিকরণের কাজ। ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট ২৭১ টি কলেজকে সরকারি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এরপর ধাপে ধাপে এ তালিকায় ঠাঁই হয় তিন শতাধিক কলেজ। স্কুল-কলেজ মিলিয়ে এ সংখ্যা প্রায় ছয় শতাধিক। শুরু হয় শিক্ষকদের আত্তীকরণের কাজ।
এর জন্য শিক্ষকদের যাবতীয় কাগজপত্র প্রথমে মাউশি আঞ্চলিক পরিচালক কর্তৃক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সরেজমিনে, দ্বিতীয়বার মাউশি অধিদপ্তর ঢাকায় এবং তৃতীয় দফায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শেষ হয়। এই তিনবার যাচাই-বাছাইয়ে প্রায় প্রত্যেকটি স্কুল কলেজের ৪০ শতাংশ শিক্ষক-কর্মচারীর ফাইল আটক করা হয় যা পরবর্তীতে আবারও যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়। এই তিনদফা যাচাই-বাছাই শেষে চুল-ছেঁড়া বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফাইলগুলো পাঠানোর পর সচিব কমিটির সভায় আবারও অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের নামে আটকে দেওয়া হয়! এটা সত্যিই দুঃখজনক! অনভিপ্রেতও বটে! শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য খুবই পীড়াদায়কও! শিক্ষকদের প্রতি কেন এমন আচরণ?
দীর্ঘ ৮ বছর ধরে চলছে সরকারিকরণের কাজ। কিন্তু নিয়োগ শেষ হয়নি এখনও অর্ধেকেরও! বেতন পাওয়ার তালিকা ৫০টি প্রতিষ্ঠান অতিক্রম করতে পারেনি এখনও! এরমধ্যেই নতুনকরে বিভিন্ন অযুহাতে ফাইল আটকে রাখা মেনে নেওয়া যায় না! হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী এবারের কুরবানির ঈদও ভালোভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে করতে পারবেন না বলে আমার আশংকা!
এ পরিস্থিতিতে নতুন সরকারি হওয়া স্কুল-কলেজগুলোর শিক্ষকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেক শিক্ষক বলছেন সরকারি না করে বেসরকারি থাকলেই বোধহয় ভালো হতো। অনেকেই বলছেন আমরা এখন না সরকারি, না বেসরকারি। অনেকেই আবার বলছেন উপজেলাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার হলেও কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। অভিভাবকগণ চায় নামে সরকারি কলেজ কাজেও যেন সরকরি হয়। তাদের সন্তানদের বেতন ও ফি নেওয়া হোক সরকারি নিয়মে। কেউ বলছেন সরকারি কলেজে ভর্তি করেও বেসরকারি নিয়মে বেতন ও ফি দেওয়া অমানবিক! আমরা এর প্রতিকার চাই। আবার শিক্ষার্থীরাও ক্লাস থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। আট বছর ধরে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় সকল কলেজেই রয়েছে শিক্ষক সংকট।
দ্রুত এডহক নিয়োগের জন্য সরকারি কলেজ স্বাধীনতা শিক্ষক সমিতি (সকস্বাশিস) এর পক্ষ থেকে বারবার যোগাযোগ করা হয়েছে। আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু কার্যকর কোনো ফলাফল নেই। স্কুল-কলেজের এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী শূণ্য হাতে অবসরে গেছেন। প্রতিদিনই কেউ না কেউ অবসরে যাচ্ছেন। এটা খুবই দুঃখজনক! "সরকারিকৃত কলেজ শিক্ষক ও কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা ২০১৮" নামের কালো বিধি তৈরি করে সরকারি কলেজে ক্যাডার ও নন ক্যাডার নামে বিভাজন তৈরি করা হয়েছে।
তাছাড়া সেখানে নেই কোনো প্রমোশন বা পদ সোপানের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা। সরকারি হয়েও নেই বদলির ব্যবস্থা! বিধিমালায় থাকলেও ক্যাডারে আত্তীকরণের নেই কোনো বাস্তবায়ন। চাকরি জীবনের অর্ধেক কাউন্ট করার কথা বলা হলেও সেটা শুধু পেনসনে! ইনডেক্স নিয়ে যারা অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারিকৃত প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেছেন তাদের পূর্বের চাকরিকাল কাউন্ট করার নেই কোনো স্পষ্টতা। আমাদের শিক্ষকগণ যাবে কোথায়?
বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। শিক্ষাক্ষেত্রেও দেশের উন্নয়ন অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। ডিজিটাল বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে গড়াচ্ছি। ইতোপূর্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা জাতিসংঘ ঘোষিত 'সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Millennium Development Goals -MDGs)' এর ৮টি লক্ষ্যমাত্রার সবকটি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।
বর্তমানে জাতিসংঘ ঘোষিত 'টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goals-SDGs)' এর ১৭ টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে যা আমাদেরকে ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত উপজেলা ভিত্তিক একটি করে হাইস্কুল ও একটি করে কলেজ সরকারিকরণ এসডিজি'র ৪ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। এর মাধ্যমে সারা দেশব্যাপী মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
তবে মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণে শিক্ষকদের মানসম্পন্ন সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। মানসম্পন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষকদের দ্বারা মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা অনেকটা দূরুহ ব্যাপার।
মানসিক তুষ্টি না থাকলে মন থেকে প্রকৃত শিক্ষা বিলানো অসম্ভব। সদ্য সরকারিকৃত এসব স্কুল কলেজের চলমান সমস্যা সমাধান করতে পারলে দেশ এগিয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। অন্যথায় জাতিকে পস্তাতে হবে আজীবন!
লেখক-
সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত)
সরকারি কলেজ স্বাধীনতা শিক্ষক সমিতি
কেন্দ্রীয় কমিটি।