বিসিএস নন-ক্যাডার নিয়োগের দীর্ঘসূত্রিতার অবসান হোক,বেঁচে যাক মেধা
বাংলাদেশ নামক বিশাল জনসংখ্যার দেশে,বিসিএসের মতো বিশাল প্রতিযোগিতামূলক পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরির সুপারিশ না পাওয়াটাকে ইতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখার অবকাশ নেই।গত ১৯ জুন ৪৫ তম বিসিএস প্রিলিমিনারী পরিক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, যার প্রতিযোগীর সংখ্যা বিশ্বের ৫৪টি দেশ ও অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি ওয়ার্ল্ডোমিটারসের সর্বশেষ তথ্যে এটি উঠে এসেছে।আর বিসিএস পরিক্ষাকে দেশের সকল চাকরি পরিক্ষার মাদার পরিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যার সব ধাপ পার হতে হলে ১৫০০ নম্বরের বিশাল সিলেবাসের পরিক্ষায় পাশ( প্রিলি,লিখিত, ভাইবা) হয়ে আসতে হয়।এর চেয়ে বিশাল সিলেবাসের চাকরি পরিক্ষা দেশে আর দ্বিতীয়টি নেই।
২০১৮ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার, লাগাতার তৃতীয় মেয়াদে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে, আর ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ এ সরকারের সাংবিধানিক মেয়াদও শেষ হতে চলেছে।২০১৮ সালে যারা, অনার্সে ভর্তি হয়েছিল তাদের স্নাতক ডিগ্রী ২০২২ সালে সম্পন্ন হয়েছে। আবার, ২০১৮ সালের,১১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল বর্তমানে বহুল আলোচিত ৪০তম বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি,কিন্তু কি অদ্ভূত বিষয় শুধু মাত্র সামান্য সদিচ্ছার অভাবে, বিধি নামক নিয়মের দোহাই দিয়ে ৫ বছর অতিক্রম করে, ৬ বছর শেষ হতে চললো একটি মাত্র বিসিএসের কার্যক্রম।তাও দেশের শিক্ষিত চাকরি প্রত্যাশী সমাজের আস্থার আতুর ঘর খ্যাত, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন এখনো ৪০ তম বিসিএস নন-ক্যাডারের সুপারিশ করতে পারলো না। এ ব্যর্থতা কখনো বর্তমান কমিশন এড়িয়ে যেতে পারবেন না।
এই বিসিএস পরিক্ষার প্রিলিমিনারী পরিক্ষা হয়েছিল ২০১৯ সালের ৩ মে,ঘূর্ণিঝড় ফণি সেদিন বাংলাদেশে আঘাত হেনেছিল,(আবার ২০২৩ সালে ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হেনে গেলো তাও যেন ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডারদের হতাশার দিন শেষ হচ্ছে না)।পরবর্তীতে ২৭ জানুয়ারি,২০২০-এ এই বিসিএসের লিখিত ফল প্রকাশিত হয়, মার্চে আসে করোনা মহামারি যার ফলে অসংখ্য বার ভাইবার সিডিউল পরিবর্তন করে এক বছরে ভাইবা সম্পন্ন হয়,অর্থাৎ ২০২১ সালের মার্চে।আবার এই বিসিএসের ভাইবা কার্যক্রম মাঝখানে স্থগিত রেখে ৪২তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে কয়েক হাজার ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হয়।সবচেয়ে হতাশার বিষয় হলো যেসকল মেধাবী চাকরি প্রত্যাশীরা ২৫ বছর বয়সে আবেদন করেছিল, তাদের বয়স এখন ৩০ বছর অতিক্রম করেছে।যারা ২৯ বা ৩০ বছর বয়সে আবেদন করেছিল তাদের বয়স এই ৫ বছরে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা সহজেই অনুমেয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নারীর ক্ষমতায়ন কার্যক্রম আজকে বিশ্বে রোল মডেল।এখানে উল্লেখ্য, বিসিএস পরিক্ষায় একটি বিশাল সংখ্যক মেধাবী নারী প্রার্থী অংশ নিয়ে তাদের মেধার সাক্ষর রেখে দেশ ও জাতির কল্যানে ভূমিকা রাখছেন।কিন্তু,৪০ তম বিসিএস নন-ক্যাডারে সুদীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছরেও সুপারিশ না পেয়ে সেই মেধাবী নারী প্রার্থীগণ আজকে ঘরের চার দেয়ালের ভিতর হতাশায় নিমজ্জিত ও তাদের অধিকাংশের বয়স শেষ হওয়াতে তাদের জীবনের সকল অর্জনকে আজকে বৃথা মনে করছেন।বেগম রোকেয়া বিংশ শতকে বলেছিলেন নারীরা যেন নিজ যোগ্যতায় নিজের পায়ে দাঁড়ায়।কিন্তু, এখন তারা যেন নিজ পায়ে ভর করে দাঁড়ানোর যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েও, যেন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না।তাদেরকে চরমভাবে আশাহত করা হচ্ছে একটি মাত্র সদিচ্ছার অভাবের মধ্য দিয়ে।৪০তম বিসিএসে অসংখ্য মেধাবী নারী প্রার্থী রয়েছেন, তাঁরা এখনো তাদের মেধার প্রাপ্য মূল্যায়ণ পাচ্ছেন না।এ দায়ভার আমাদের জাতিকে অবশ্যই নিতে হবে।
উল্লেখ্য ,যেখানে দেশের ইতিহাসে মহামারি পরবর্তী সরকারি চাকরিতে বর্তমানে
[১৯ লাখ ১৫১টি অনুমোদিত পদ রয়েছে। এসব পদের বিপরীতে ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮১৮ জন কর্মরত আছেন;]ফাঁকা পদ রয়েছে ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৯৭৬টি।অর্থাৎ,২৫.৭৮৬ শতাংশ শূন্য পদ বিদ্যমান যা মোট পদের এক-চতুর্থাংশই ফাঁকা।এটিই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শূন্য পদের হিসেব, প্রায় পাঁচ লক্ষ। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে এই পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। সূত্র:বিডিনিউজ২৪.কম(১জুন,২০২৩)।যেখানে, সরকারি চাকরিতে ২৫ শতাংশ পদ শূন্য থাকা কোনোক্রমেই রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্রের জন্য শুভ লক্ষ্মণ নয়।কোনো কাজে ব্যাঘাত না ঘটাতে সরকারি দপ্তরগুলোর জন্য নতুন নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়।এছাড়া অবসর জনিত কারণে প্রতিনিয়ত শূন্য পদও সৃষ্টি হয়। কিন্তু শূন্য পদ পূরণ করতে দীর্ঘ সময় লেগে গেলে এর সুফল জনগণ পায় না।
পরিলক্ষিত হয় পিএসসি’র মাধ্যমে ক্যাডার পদের পাশাপাশি, ৯ম থেকে ১২তম গ্রেডে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ দিতে[১] নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ(বিশেষ) বিধিমালা-২০১০ ও [২]সংশোধিত (বিশেষ)বিধিমালা-২০১৪ প্রনয়ন করে সরকার। যা নিসন্দেহে একটি সময়োপযোগী ও স্মার্ট উদ্যোগ ছিল।সেসকল বিধির মাধ্যমে ২৮তম বিসিএস থেকে ৩৮তম ও পাশাপাশি সময়ে ৪২তম বিসিএসে নন-ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়া হলো।৩০ মার্চ,২০২২ তারিখে ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার ঠিক আগের দিনও ৩৯তম বিসিএস নন-ক্যাডারদের সুপারিশ করে বর্তমান কমিশন ঐসকল বিধির আওতায়।কিন্তু বাদ সাধে ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডার নিয়োগ দিতে, অথচ এসকল বিধির আওতায় ৪০তম বিসিএস ননক্যাডার থেকে নিয়োগ দিতে আবেদনপত্র আহ্বান করে আবার সুপারিশ করার সময় এসে বেঁকে বসে পিএসসি।
একটি বিষয় উল্লেখ করার অবকাশ রাখে,সরকারের নিকট থেকে শূন্য পদের রিকুইজিশন না পেলে কমিশন নন-ক্যাডার পদে সুপারিশ করতে বাধ্য নয়।কিন্তু সরকারের নিকট হতে শূন্য পদের প্রাপ্যতা সাপেক্ষে এবং প্রার্থীর একাডেমিক যোগ্যতা ও অন্যান্য উপযুর্ক্ততা বিবেচনায় নন-ক্যাডার পদে সুপারিশ প্রাপ্তিতা নির্ভর করবে।অর্থাৎ, সরকারের নিকট থেকে শূন্য পদের রিকুইজিশন পেলে এ কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে বাঁধা নেই ।
[১]নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ(বিশেষ) বিধিমালা-২০১০ এর ২৬৮৭ পেইজের ৫-নং পয়েন্টের উপ-বিধি ২ এ বর্ণিত কমিশন কর্তৃক নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ লাভে আগ্রহী প্রার্থীদের নিকট হতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদনপত্র আহ্বান করতে পারবে কমিশন।
সে অনুযায়ী- ২৯ মে,২০২২ তারিখে ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডারে সুপারিশ লাভে আগ্রহী প্রার্থীদের মধ্যে আবেদনপত্র আহ্বান করা হয় যা ২ জুন থেকে ১৬ জুন,২০২২ পর্যন্ত চলমান ছিল।৮,১৬৬ জন নন-ক্যাডারের মধ্যে অনলাইন আবেদন জমা দেয় সর্বসাকুল্যে ৬০০০ এর উপরে প্রার্থী।উল্লেখ্য, কয়েকমাস পূর্বে মহান জাতীয় সংসদে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জনাব ফরহাদ হোসেন তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডারের নামে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার পদ জমা হয়েছে এছাড়া, প্রথম আলো ২৯ এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে কমপক্ষে চার হাজার পদের কথা উল্লেখ করে। এদিকে চার সহস্রাধিক পদের কথা উঠে এসেছে দৈনিক ইত্তেফাকে- ২৮ এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে। তাই সহজেই অনুমেয় বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের, ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডারদের সুপারিশ করতে আর কোনো বাঁধা থাকে না।তবে, নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য পূর্বের দুটি বিধিমালাকে সংশোধন করে "নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ (সংশোধিত বিশেষ) বিধিমালা-২০২২" অনুমোদন দিতে দীর্ঘ সময় লাগায়,তারা এখনও সুপারিশ পায়নি।যদিও অতি শীঘ্রই সুপারিশ পেতে যাচ্ছেন তারা।এটি অবশ্যই বর্তমান সরকারের জন্য একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি বয়ে আনবে।এরপরও ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডারগণ সুপারিশ প্রাপ্তির পূর্বদিন পর্যন্ত পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে চরম হতাশায় নিমজ্জিত।
এদিকে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যভুক্ত সাতটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র অফিসার পদে জনবল নিয়োগের জন্য ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এগুলোর মধ্যে ছয়টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ কার্যক্রম শেষে প্রার্থীদের যোগদান করালেও রূপালী ব্যাংকে ২১১ জন সুপারিশপ্রাপ্তকে এখনো নিয়োগপত্র দেয়নি।সিনিয়র অফিসারে সুপারিশ পাওয়াতে, অন্য চাকরিতে সুপারিশ পেয়েও যোগদান করেননি তাঁরা।এখন চাকরি পেয়েও তাঁরা বেকার জীবন যাপন করছেন যা খুবই অমানবিক বিষয়। কিন্তু একই সঙ্গে সুপারিশ পেয়ে অন্যরা যোগদান করে বেতন-ভাতা ঠিকই পাচ্ছেন।এটা সত্যিই হতাশার বিষয়।
আবার,কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে নিজের অর্জিত সনদ পুড়িয়ে কোনো নিয়োগ পরিক্ষায় অংশগ্রহন ছাড়াই সোনার হরিণ খ্যাত সরকারি চাকরি পেয়ে যাওয়াতে অন্যান্য যোগ্য মেধাবীরা আজকে আশাহত।স্বভাবতই ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডার সুপারিশ প্রত্যাশীদের মনে প্রশ্ন উঠে বয়স শেষ হলে সনদ পুড়িয়ে ফেললেও যদি সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়া যায় কোনো ধরনের নিয়োগ পরিক্ষা ছাড়াই, তবে যারা এতো দীর্ঘ কন্ঠকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেও তারা সময়মত সুপারিশ পেতে এতো বেগ পোহাতে হবে?যেখানে ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত রেজাল্ট প্রকাশিত হয়েছিল আরো ১৫ মাস পূর্বে ৩০ মার্চ, ২০২২ তারিখে।
আবার সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে এখন লোকবলের সংকটে স্বাভাবিক কাজ সম্পাদন করতে সরকারি অর্গানিজমগুলো হিমসিম খাচ্ছে। যার ফলে, জনগণ উপযুক্ত সেবা হতে বঞ্চিত হচ্ছে।যার দরুণ ভবিষ্যত স্মার্ট বাংলাদেশের মেধাবী তরুনরা চরমভাবে আশাহত। যা একটি জাতির সুষ্ঠু বিকাশ ও সমৃদ্ধি কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়, একটি শিক্ষিত মেধাবী জাতির প্রথম দাবি হচ্ছে তাদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ণ পাওয়া।সেই সাথে মেধাবীদের কাজে লাগিয়ে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।তাই এখন সময়ের দাবি ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডার ও রূপালী ব্যাংক কর্মকর্তাগণের নিয়োগ দিয়ে মহামারি পরবর্তী দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে, এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বিশ্ব সংকটের পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শীতলতা থেকে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং তাদের মেধার সঠিক মূল্যায়ণসহ, পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গঠনের স্বপ্ন পূরণ ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ঘোষিত ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।এতে দেশ ও জাতি প্রকৃত সেবাটুকু পাবে।সেই সাথে মেধাবী তরুনরা তাদের আত্মবিশ্বাসও বাড়বে।যা দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
লেখক-
এস.এম.আশরাফ সিদ্দিকী।
শিক্ষক