বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
গোলাম কিবরিয়া ভূইয়াঃ কয়েকদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই বাজেটে শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন ও বার্ষিক আয়-ব্যয়ের জন্য অর্থ সংকুলান করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। ইউজিসি প্রতিষ্ঠার পর এ বছরই সম্ভবত সবচেয়ে বড় আকারের বাজেট অনুমোদন দেন।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি বর্তমান বাংলাদেশে ১১১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের বেশির ভাগই ঢাকাকেন্দ্রিক হলেও বর্তমানে সারাদেশেই বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১৯৭৩ এর বিশ্ববিদ্যালয় আইন বলবৎ রয়েছে। অপরদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ কার্যকর রয়েছে। যদিও এই আইনটির কিছু ধারা পর্যালোচনার দাবি রাখে। ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হলেও ২০১০ সালে এসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সুনির্দিষ্ট একটি আইন লাভ করে। এই আইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও বোর্ড অফ ট্রাস্টিজের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সম্পর্কে বলা আছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যেক্তাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। কিন্তু বিওটির সদস্যরা বা উদ্যোক্তাগণ বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করলেও আর্থিক সহযোগিতার বিষয়টি প্রায়ই অবহেলিত থাকে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন শ্লথ হয়ে পড়ে। স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা নির্দিষ্ট সময়ে সম্ভব হয় না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠার ১০ বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে মর্মে নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নির্দেশনা অনুযায়ী স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সাধারণভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দেখাশোনা করে থাকে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অথবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কোন অর্থ বরাদ্দ করে না অথবা ঋণ প্রদান করে না। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থায়ী ক্যাম্পাস সৃষ্টিতে অথবা একাডেমিক উন্নয়নে যে অর্থের প্রয়োজন তা জোগান দিতে পারছে না। ঢাকা শহরের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি অনেক বেশি। প্রতি ক্রেডিটে যে পরিমাণ টিউশন ফি ধার্য করা আছে তা মফস্বল শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। স্বাভাবিক কারণেই মফস্বলের এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। এই অবস্থা উত্তরণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ভূমিকা রাখতে পারে। বেসরকারি স্কুল ও কলেজগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা দেয়া হয়ে থাকে। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা বা বিকল্প নেই।
একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করে থাকে। তাই বেসরকারি শিক্ষাখাতেও ভর্তুকি, অনুদান বা ঋণ প্রদান বাঞ্চনীয়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রয়োজনীয় সুপারিশ বা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। দেশের শিক্ষা উন্নয়ন এখন সময়ের দাবী। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় যেহেতু ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল সেক্ষেত্রে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ প্রদান বিষয়টি এক্ষেত্রে বিবেচ্য হতে পারে। অর্থাৎ ইউজিসি কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারে এবং কমিশনের অর্থায়নে বা প্রদত্ত মাসিক বেতনে এসব শিক্ষক কাজ করতে পারে।
বর্তমানে ইউজিসি ও মন্ত্রণালয় প্রতিনিধি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিন্ডিকেটে দায়িত্ব পালন করে থাকে, সেক্ষেত্রে তাদের জন্য প্রযোজ্য টিএ ও ডিএ মঞ্জুরি কমিশন ও মন্ত্রণালয় বহন করতে পারে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে জার্নাল প্রকাশ করার উদ্যোগকে মঞ্জুরি কমিশন আর্থিক সহায়তা দিয়ে সমর্থন দিতে পারে। তবে এসব জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লিখিত মৌলিক প্রবন্ধ হতে হবে এমন শর্তে তা করা প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানে দেশের পাবলিক বা প্রাইভেট উদ্যোগে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্বৈত চরিত্রের হওয়ায় এগুলো তেমনভাবে বিকশিত হতে পারছে না বলে জানা যায়। এক্ষেত্রে মঞ্জুরি কমিশন দুপক্ষকে লিখিতভাবে শর্ত প্রদান করতে পারে। যা হয়তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সুস্পষ্ট ভাবে বলা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৪৪ (ক) ধারায় বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ তহবিলের অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনে বহন করার বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে আয়ের কতো ভাগ ব্যয় করা যাবে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। অপরদিকে বোর্ড অফ ট্রাস্টিজের সদস্যরা মুনাফা সরাতে পারবে না বলে আইনে থাকলেও বাস্তবে এটি নানা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় অবকাঠামো উন্নয়নে মঞ্জুরি কমিশন নিজস্ব ফান্ড সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এই ফান্ড থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তি ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা, স্থায়ী ক্যাম্পাসে ভবন নির্মাণ ইত্যাদিতে অনুদান বা ঋণ প্রদান করতে পারে। এক্ষেত্রে অতি নিম্নহারে সুদ ধার্যকরে সর্বোচ্চ সময়সীমা নির্দিষ্ট করতে হবে। শিক্ষা উন্নয়ন ও মানসম্মত পরিবেশ সৃষ্টিতে এ ধরনের সহায়তা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
আয়ের সর্বোচ্ছ ১০ থেকে ১৫ ভাগ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের প্রয়োজনে বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ ব্যয় করতে পারবে এই মর্মে একটি নির্দেশনা থাকা আবশ্যক। সর্বোপরি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনিক চরিত্র এবং অর্থায়ন যেভাবে কার্যকর আছে তা রিভিউ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে মঞ্জুরি কমিশন উদ্যোগী হতে পারে।
লেখক: উপাচার্য, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৫/০৭/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়