বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা হওয়ার পথে প্রাইভেট-কোচিং!
।। ড. কে এম আতিকুর রহমান।
এমন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া ভার যে, সে প্রাইভেট-কোচিং করে না। মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে গড়ে উঠছে অসংখ্য কোচিং সেন্টার। তাছাড়া ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়েও অসংখ্য ছেলে-মেয়ে কোচিং পেশার সাথে জড়িত। প্রাইভেট-কোচিং এখন একটা পেশার নাম। কারণ, সদ্য স্নাতক হওয়া অথবা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছেলেমেয়েরাই মূলত এ পেশায় জড়িত
। শিক্ষকরাও এক্ষেত্রে কম যাচ্ছেন না। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ব্যবহার করে অথবা আশেপাশে ঘর ভাড়া করে কোচিং ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই শিক্ষকমন্ডলীর মূল দায়িত্বটা (শ্রেণিকক্ষে পাঠদান) তখন দ্বিতীয় পর্যায়ের দায়িত্বে পরিণত হয়। সকাল-বিকাল প্রাইভেট পড়িয়ে তিনি এমনিতেই ক্লান্ত থাকেন; তাই শ্রেণিকক্ষের কাজটাকে বিশ্রামের অবলম্বন হিসেবেও অনেকে ব্যবহার করেন। কোচিং পেশাটা এখন বেশ জমজমাট; কারন পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষার্থী সেন্টারগুলোতে আসছে নিয়মিতভাবে।
কোচিং সেন্টারে মাসে ৮০০/১০০০ টাকায় ৩/৪টি বিষয় পড়ানো হয়, যা শিক্ষার্থীদের নিকট খুবই আকর্ষণীয়। পর্যবেক্ষনে দেখা যাচ্ছে, কোচিং করা ছেলে-মেয়েরা সবাই যে পরীক্ষায় ভাল করছে, তা কিন্তু নয়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের পারফরমেন্স অসন্তোষজনক। তারপরও তারা কোচিং-এ যাচ্ছে। কারণ, বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলোতে প্রকৃত লেখাপড়া এখন কমই হচ্ছে। বাস্তবে শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে ও শিক্ষার্থীদের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক নয়।
তারা শ্রেণিকক্ষে যাচ্ছেন, কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থীদেরকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করছেন না। শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত¡ বুঝে, তাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে খুব কম সংখ্যক শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। শ্রেণিকক্ষের বাইরে তারা শিক্ষার্থীদের কোন সমস্যা সমাধান বা তথ্য সেবা প্রদানে একেবারেই আন্তরিক নয়।
তাহলে, শিক্ষকরা কী করেন? তারা মূলত: বৈষয়িক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়েই বেশি আগ্রহী। বাজারের উত্তাপ তাদেরকে বৈষয়িক স্বার্থে বেশী মনোযোগী করে তুলেছে। কোচিং ব্যবসার পাশাপাশি করণিক কাজ বা পাশর্^-ব্যবসায় তারা বেশী ঝুকে পড়ছে। শিক্ষাদানের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া, পরিশ্রম করার মত মানসিকতাও শিক্ষকের মাঝে কিঞ্চিৎ পরিলক্ষিত হয়।
অন্যদিকে বেকারত্বের অধিক হার সদ্য ¯œাতকদের কোচিং পেশায় নিয়ে এসেছে। এখানে তাদের আয়-উপার্জনও বেশ ভাল। অনেকে এখন অন্য পেশায় যাওয়ার কথা চিন্তাও করে না।কোচিং সেন্টারগুলো এক ধরনের বিনোদন কেন্দ্র হিসেবেও নিজেকে করেছে। স্বাধীনভাবে মোবাইল ফোনের ব্যবহার, ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলামেশা, এ সেন্টারগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
প্রতিমাসেই শিক্ষক-কাম-ভাইয়ার পৃষ্টপোষকতায় কোন না কোন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, যা শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। মা-বাবা দেখছে আমার সন্তান পড়ালেখায় খুবই আন্তরিক; সারাদিন কোচিং-এ যাওয়া-আসা করে খুবই ব্যস্ত সময় পার করে। যদিও ক্লান্ত শরীরে সন্তানরা সন্ধ্যা বেলায়ই ঘুমিয়ে পড়ছে; পড়ার টেবিলে যাওয়ার মত সুযোগ আর থাকছে না। মা-বাবা এতে কিন্তু বিরাগভাজন না হয়ে বরং খুশীই হচ্ছে; কারণ তারা মনে করছেন, সন্তানটা সারাদিন পড়ালেখায় ব্যস্ত ছিল, তাই এ অবস্থা।
বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কোচিং সেন্টারগুলোতে “শিট ভিত্তিক ও গতানুগতিক” পড়ালেখা তেমন কোন কাজে আসছে না; কারণ কোচিং সেন্টারের লেসনগুলো চর্চার অভাবে অর্থহীন হয়ে পড়ছে। পরিতাপের বিষয় হলো, কোচিংগামী শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে নিয়মিতভাবে অনুপস্থিত থাকছে। কারণ, ক্লাসের সময়ই কোচিং সেন্টারগুলোও ক্লাস ও পরীক্ষা নিচ্ছে। যেহেতু শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত থাকলে ফরম পূরণ ও পরীক্ষা পাসে কোন সমস্যা হচ্ছে না, সেহেতু “কোচিং বিনোদনটাই” তাদের বেশী টানছে।
পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে উপস্থিত থেকে কিছু লিখলেই পাস নাম্বার চলে আসছে। তাই কোচিং সেন্টার অনেক বেকারের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষার্থী আসুক, সেটাতে প্রশাসন ও শিক্ষকের আন্তরিকতার দারুন ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। প্রশাসন ও শিক্ষক সবাই কিন্তু অন্য কাজে ব্যস্ত। এত কোচিং, এত পাসের হার, কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ¯œাতক (সম্মান) শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীও মুক্ত হাতে একটা প্রতিবেদন, পত্র লিখন ও রচনা লিখতে পারছে না। লেখার কোথায় শুরু এবং কোথায় শেষ করতে হবে, কিছুই বলতে পারে না। বানান-বিরামচিহ্ন ব্যবহার না করেই ইচ্ছে মতো লিখে যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের আচরণ আজ এতটাই পরিবর্তন হয়েছে যে, যোগাযোগ দক্ষতা, সামাজিক দক্ষতা জানা তো দূরের কথা, সঠিকভাবে কথাও বলতে পারে না। ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদেরকে নিয়ে বচসা তৈরি হচ্ছে, যা কাম্য নয়। কোথায়, কারও সঙ্গে কথা বলতে কোন শব্দ ব্যবহার করতে হবে, কোন টোনে বা মেজাজে কথা বলতে হবে, তা তারা বুঝতে পারে না। কোচিং সেন্টারে, শ্রেণিকক্ষে বা পরিবারে এগুলো চর্চাও হচ্ছে না। অথবা চর্চা করানো যাচ্ছে না । কারন পরীক্ষার পড়া ব্যতীত অন্য কাজকে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই বিষ মনে করে।
অনেক শিক্ষক নিজেও এগুলো সঠিকভাবে জানে না; তাই চর্চাতেও তারা আগ্রহী নয়। কোচিং-এ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে শিক্ষার্থীদের খাদ্যাভাস, স্বাস্থ্যভ্যাস মাথা কুঁড়ে মারা যাচ্ছে। ফলে প্রকৃত শিক্ষাহীন, স্বাস্থ্যহীন একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যাদের মিশন-ভিশন বলে কিছু আছে তা মনে হয় না। সময় জ্ঞান, ন্যায় ও শৃঙ্খলাবোধ আজ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। মা-বাবা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সকল শ্রেণিই আজ মোবাইল ফোনভিত্তিক আনন্দ আর অর্থ-বিত্ত কেন্দ্রিক জীবন গড়ে তোলায় ব্যস্ত।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৪/০৬/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়