বিএনপিতেও ৬৭ ভুঁইফোঁড় সংগঠন
নিউজ ডেস্ক।। বিএনপি যখন ক্ষমতায় তখন দলটির রাজনীতির পরিমণ্ডলে গড়ে উঠেছিল অনেক 'ভুঁইফোঁড়' সংগঠন। মূলত দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ শব্দ ঘিরে গড়ে উঠেছিল সংগঠনগুলো। বিভিন্ন ইস্যুতে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করত তারা। তবে ২০০৬ সালে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর এবং সর্বশেষ ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এসব সংগঠনের অনেককেই আর দেখা যায়নি। রাজনৈতিক এই 'দোকানগুলো' বন্ধ হতে শুরু করে। অনেক কর্ণধার সুযোগ বুঝে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। কেউ কেউ বিএনপির রাজনীতি থেকে পদত্যাগ করেছেন।
তবে কিছু সংগঠন এখনও চেষ্টা করছে সক্রিয় থাকার। বিভিন্ন ইস্যুতে জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকায় এসব সংগঠন তৎপর। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দলের 'কোণঠাসা' নেতাকে অতিথি করে আলোচনায় রাখার কৌশল নিত এসব সংগঠন। চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে অনেক সংগঠনের বিরুদ্ধে।
বিএনপির কিছু নেতা অবশ্য বিষয়টিকে ভিন্নভাবেও দেখেন। দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় যখন রাজনীতির সুযোগ ছিল না, তখন প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠান আয়োজন করে এসব সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এসব সংগঠন বিএনপির স্বীকৃতির ওপর নির্ভরশীল নয়। তারা নিজস্ব গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলবে। এসব সংগঠনের আয়োজনে
প্রোগ্রামে গিয়ে বিএনপি নেতারা দলের পক্ষেই কথা বলছেন। তারা বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি করছেন। এতে খারাপ কী?
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এসব সংগঠনের কারণে প্রায় সময় দলের নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত হন। এতে মূল দল ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হয়। সামাজিক সংগঠনের বাইরে বিএনপি কিংবা জিয়া পরিবারের নামে এসব সংগঠন করা উচিত নয়।
বিএনপির ভুঁইফোঁড় অন্তত ৬৭টি সংগঠনের নাম জানা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে- জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দল, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক একাডেমি, সম্মিলিত সমন্বয় পরিষদ, জিয়া নাগরিক ফোরাম, জিয়া আদর্শ একাডেমি, তৃণমূল দল, জিয়া সেনা, স্বদেশ জাগরণ পরিষদ, দেশনেত্রী সাংস্কৃতিক পরিষদ, দেশপ্রেমিক ফোরাম, জিয়া স্মৃতি সংসদ, চেতনায় ৭১, সচেতন নাগরিক ফোরাম, চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ, নাগরিক অধিকার সোসাইটি, গণতান্ত্রিক ঐক্য ফোরাম, গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক জোট, জাগ্রত জনতা ফোরাম, নাগরিক পরিষদ, গণমুক্তি আন্দোলন পরিষদ, প্রজন্ম একাডেমি, নাগরিক সংসদ, সুশীল ফোরাম, নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ, চিরন্তন বাংলাদেশ, হৃদয়ে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইয়ুথ ফোরাম, জিয়া পরিষদ, তৃতীয় স্বর, দেশপ্রেমিক যুবশক্তি, নাগরিক ফোরাম, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক জোট, সচেতন নাগরিক পরিষদ, গ্রুপ-৯, আমরা ঢাকাবাসী, বাংলাদেশ সচেতন যুব সমাজ, সচেতন দেশপ্রেমিক, ফোরাম, জিয়া নাগরিক সংসদ, সামাজিক আন্দোলন সংস্থা, গণতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, সচেতন যুব সমাজ, স্বদেশ মঞ্চ, জিয়া ব্রিগেড, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সেবা দল, জাতীয়তাবাদী বন্ধু দল, ডেমোক্রেটিক কাউন্সিল, নাগরিক মঞ্চ, সমবায় দল, জাতীয়তাবাদী দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন, জাতীয় মানবাধিকার সমিতি, জিয়া ন্যাশনালিস্ট ফোরাম, বাংলাদেশ উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিষদ, বাংলাদেশ সচেতন যুব সমাজ, বাংলাদেশ মানবাধিকার ফোরাম, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, চেতনায় মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয়তাবাদী নাগরিক সংসদ, জাতীয়তাবাদী বাউল দল, জাতীয়তাবাদী কর্মজীবী কল্যাণ পরিষদ, খালেদা জিয়া মুক্তি পরিষদ, তারেক রহমান মুক্তি পরিষদ, তারেক রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সংগ্রাম পরিষদ, শহীদ জিয়াউর রহমান আদর্শ বাস্তবায়ন পরিষদ, জাতীয়তাবাদী কৃষি আন্দোলন, জনতার ধ্বনি, আজকের প্রজন্ম। ২০১৪ সালের আগস্টে ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলোর মধ্যে ৩৮টি সংগঠন মিলে 'বিএনপির সহযোগী সংগঠন ঐক্য পরিষদ' গঠন করেছিল। এর কোনো অস্তিত্ব এখন নেই।
'জি-নাইন (গ্রুপ-২০০৯)' ও 'শত নাগরিক কমিটি' নামে দুটি সংগঠনকে দলের 'থিঙ্কট্যাঙ্ক' হিসেবে মর্যাদা দেয় বিএনপি। নব্বই দশকের ছাত্রনেতাদের করা সংগঠনের পাশাপাশি 'নারী ও শিশু অধিকার ফোরাম' নামের সংগঠনকেও গুরুত্ব দেয় বিএনপি।
ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলোর কয়েকটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা অনেকবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন- জাতীয়তাবাদী বন্ধু দল, জাতীয়তাবাদী তরুণ দল, জিয়া ব্রিগেড, জিয়া মঞ্চ, দেশনেত্রী পরিষদ, তারেক রহমান পরিষদ, তারেক রহমান মুক্তি পরিষদসহ কতিপয় সংগঠন দেশব্যাপী বিএনপি, জিয়াউর রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের নাম ব্যবহার করে কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা সারাদেশের নেতাকর্মীদের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে।
তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনের কোনো সম্পর্ক নেই। দলের যেকোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীদের এসব অননুমোদিত সংগঠনের সঙ্গে সংশ্নিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
একইভাবে ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল জিয়া-খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের নাম ব্যবহার করে 'ভুঁইফোঁড়' সংগঠন সৃষ্টির বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশনা দেয় বিএনপি। ওই সময় 'তারেক জিয়া সেবা ফাউন্ডেশন' নামের একটি সংগঠনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। সর্বশেষ গত সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে 'শহীদ জিয়া ছাত্র পরিষদ'-এর সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছে বিএনপি।
বিএনপির পরিচয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন 'জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলন'-এর সভাপতি সানজানা আক্তার চৈতী প্রতারণার অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৬ জুন গ্রেপ্তার হন। তার আরেক সহযোগী আসাদুজ্জামান ওরফে আসাদও গ্রেপ্তার হন। এরপর থেকে সংগঠনটি নিষ্ফ্ক্রিয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কর্মজীবী দলের সভাপতি মো. লিটন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। 'হৃদয়ে বাংলাদেশ'-এর সভাপতি মেজর (অব.) মো. হানিফ সম্প্রতি বিএনপির রাজনীতি থেকে পদত্যাগ করেছেন।
'স্বাধীনতা ফোরাম'-এর সভাপতি হিসেবে রয়েছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ রহমাতুল্লাহ। তিনি সমকালকে বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে অনেক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। যেগুলোর এখন আর অস্তিত্ব নেই। দলের দুঃসময় এলে সুযোগ বুঝে তারা কেটে পড়েন। জাতীয় রাজনীতিতে এসব সংগঠন ভূমিকা না রাখলেও জনমত তৈরিতে তারা ভূমিকা পালন করে।
জিয়া শিশু-কিশোর মেলার সভাপতি ও জাসাস নেতা জাহাঙ্গীর শিকদার বলেন, দলের মধ্যে কিছু লোক আছেন যারা সুযোগসন্ধানী। তারা রাজনীতিতে আসে হালুয়া-রুটির ভাগের জন্য। ক্ষমতায় এলেই তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ক্ষমতা চলে গেলে তাদের দেখা যায় না। কিন্তু তার সংগঠন নতুন প্রজন্মের সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে কাজ করে যাচ্ছে।