বাসে ই-টিকিটিং ব্যবস্থায় ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’
শিক্ষাবার্তা ডেস্কঃ ঢাকা শহর ও শহরতলী রুটের বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়ম দূর করার জন্য ই-টিকিটিং সার্ভিস চালু করে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। সবশেষ গতকাল মঙ্গলবার আরও ১৫টি কোম্পানির ৭১১টি বাসে চালু হল এই সার্ভিস। এখন পর্যন্ত রাজধানীর প্রায় ২২০০’এর বেশি বাসে চালু হলো এই সেবা। যদিও এই সার্ভিসের বেশিরভাগ বাসে সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে ই-টিকিটিং মেশিন।
ভাড়া আদায়কারীরা গলায় মেশিন ঠিকই ঝুলিয়ে রাখছে, কিন্তু যাত্রীরা টিকিট না চাইলে কাউকে টিকিট দিচ্ছে না। টিকিট দেওয়া ছাড়াই ভাড়া আদায় করছে। ভাড়া আদায়ে মানা হচ্ছে না বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নির্ধারিত তালিকা। ওয়েবিল প্রথা বাতিল করা হলেও তা চলছে। ওয়েবিলের কারণে যাত্রী ভাড়া বাড়ছে। টিকিটে দূরত্ব কত কিলোমিটার, তার উল্লেখ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবহন শ্রমিকদের মাসিক বেতনভুক্ত না করলে ই-টিকিটিংয়ে কোন সুফল আসবে না।
৭১১টি বাসে চালু হল ই-টিকিটিং সার্ভিস:
ঢাকায় আরও ১৫ টি কোম্পানির ৭১১টি বাসে ই-টিকিট সার্ভিস চালু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার আজিমপুর, মোহাম্মদপুর, ধূপখোলা, ডেমরা, আবদুল্লাহপুর ও গাবতলী রুটে চলাচল করা বাসে এই ই-টিকিট সেবা চালু করা হয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জানান, আরও ১৫টি বাস কোম্পানির ৭১১টি বাস ই-টিকিটিংয়ের মাধ্যমে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করবে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঢাকা ও আশপাশের জেলায় চলাচলকারী দেশের সব বাস কোম্পানিকে ই-টিকিটিংয়ের আওতায় আনা হবে।
গণপরিবহনে ওয়েবিল ও বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধ করতে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর আটটি কোম্পানির বাসে পরীক্ষামূলকভাবে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা চালু করা হয়। এরপর ১৩ নভেম্বর আরও ২২টি পরিবহন কোম্পানিসহ মোট ৩০টি পরিবহন কোম্পানির মোট ১৬৪৩টি গাড়িতে ই-টিকেটিং পদ্ধতি চালু করা হয়। আর গতকাল আরও ১৫টি বাস কোম্পানির ৭১১টি বাস এই সার্ভিসের আওতায় এলো।
টিকিট ছাড়াই ভাড়া আদায়, চলছে ওয়েবিলও:
পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার কাঠেরপুল এলাকা থেকে মোহাম্মদপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় মালঞ্চ পরিবহন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অনিক ও প্রিমা দয়াগঞ্জ থেকে গুলিস্তান যাওয়ার জন্য মালঞ্চ পরিবহনের একটি বাসে উঠেন। ওয়েবিল সিস্টেম নিষিদ্ধ হওয়ার পরও বাসটি দয়াগঞ্জ এবং ওয়ারীর রাজধানী সুপার মার্কেটের সামনে ওয়েবিল কাটে। এ সময় সুপারভাইজার হাফ পাস কাটার জন্য বাসে থাকা শিক্ষার্থীদের হাত তুলতে বলেন। তখন অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে হাত তোলেন অনিক এবং প্রিমাও। এরপর গলায় ই-টিকিটিং মেশিন ঝুলিয়ে ভাড়া আদায় করা শুরু করেন হেল্পার।
পুরো বাসে ভাড়া আদায়ের সময় তাকে মেশিনে একটি টিকিট কাটতেও দেখা যায়নি। কাঠেরপুল থেকে গুলিস্তানের ভাড়া কিলোমিটার হিসেবে যাচাই করলে ১৫ টাকাও হয় না। সেখানে মালঞ্চ পরিবহন গুলিস্তানের ভাড়া আদায় করছে ২০ টাকা। তাও যাত্রীরা না চাইলে টিকিট দিচ্ছে না। দয়াগঞ্জ থেকে গুলিস্তানের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা। অনিক দুজনের স্টুডেন্ট ভাড়া ১০ টাকা দিতে চাইলে হেল্পার জানায় বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। স্টুডেন্ট হলেও ১০ টাকার কমে ভাড়া দেওয়া যাবে না।
হেল্পারের সঙ্গে বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে অনিক বলেন, ‘ওয়েবিল বন্ধ তবু তোমরা ওয়েবিল কাটো। স্টুডেন্ট হিসেবে হাফপাস কাটলাম তাও তুমি বলছো সর্বনিম্ম ভাড়া ১০ টাকা। ঠিক আছে যা ভাড়া তাই তো নিচ্ছ আমার কাছ থেকে, তাহলে গলার মেশিনটা থেকে টিকিট কেটে দাও আমাকে। আমি আমার টিকিট চাই।’ জবাবে হেল্পার জানায়, ‘মেশিনের পিনকোডে সমস্যা আছে, মেশিন কাজ করছে না।’ হেল্পারের ওই কথায় আরও কয়েকজন যাত্রী অসন্তুষ্ট হন। তারা চিৎকার করে বলে উঠেন- ‘আজকে মাত্র তোমাদের এই বাসে ই-টিকিটিং সিস্টেম চালু হলো, আর তুমি আজই অজুহাত দিচ্ছ যে মেশিন কাজ করছে না।’
মেশিন থেকে টিকিট কেটে ছিঁড়ে ফেলছেন হেল্পার:
কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বাড্ডার দিকে যাচ্ছিল যাত্রীবাহী বাস ‘অছিম’। বাসের দরজায় দাঁড়ানো ভাড়া আদায়কারী ইচ্ছামতো টিকিট কাটার মেশিন থেকে টিকিট নিচ্ছেন আর ছিঁড়ে ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলছেন। এভাবে প্রায় ২০টিরও বেশি টিকিট তিনি নিজে মেশিনে কেটে ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলেন। পরে মেশিনটি পকেটে ঢুকিয়ে ভাড়া আদায় করা শুরু করেন।
যাত্রীদের টিকিট না দিয়ে এভাবে ছিঁড়ে ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলার কারণ জানতে চাইলে বাসটির হেল্পার বলেন, যাত্রীরা টিকিট চায়ও না, তাই আমরা টিকিট দেইও না। কিন্তু আমাদের তো হিসাব রাখতে হয়, সেজন্য আমরা টিকিট কেটে ছিঁড়ে ফেলে দেই।
গণহারে টিকিট কেটে ছিঁড়ে ফেলছেন, যাত্রীরা তো একেকজন একেক গন্তব্যে যাচ্ছে। ভাড়ার পার্থক্যের হিসেবটা কিভাবে রাখছেন- এমন প্রশ্ন করলে জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনাকে আমি এত হিসাব দিতে পারবো না।’
আলতাফ হোসেন নামে বাসের এক যাত্রী বলেন, ‘এটা ওদের নিত্য দিনের কাজ। এই সিস্টেম চালু করায় যেন তাদের দুর্নীতির সুযোগ আরও বেড়ে গেছে। তারা যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নেয়, টিকিট দেয় না। পরে সময় সুযোগ বুঝে নিজেদের ইচ্ছেমত বিভিন্ন গন্তব্যের টিকিট কেটে ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। এভাবেই তারা এখন বাস মালিকদের টাকা চুরি করে যাচ্ছে।’
ভাড়া বাণিজ্যেরও অবসান হয়নি:
মিরপুর সুপার লিংক নামের একটি বাসে সাইন্সল্যাব থেকে আগারগাঁও যাচ্ছিলেন সাইফুল হক। আসাদগেট পার হতেই ভাড়া নিতে আসেন হেল্পার। তিনি গন্তব্য শুনে ৩০ টাকা ভাড়া দাবি করলেন। কিন্তু সাইফুল তখন ভাড়া বেশি চাওয়ায় প্রতিবাদ করেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এক পর্যায়ে সাইফুল বলেন, ‘আমাকে চার্ট দেখান, কিলোমিটার হিসেব করে চার্ট অনুযায়ীই আমি ভাড়া দেব।’ তখন হেল্পার ভাড়ার নির্ধারিত তালিকা দেখাতেও অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে সাইফুল বলেন, ‘ঠিকআছে মেশিনে টিকিট কেটে দেন, যা ভাড়া আসে তাই দিচ্ছি।’ এবার হেল্পার একটু অপ্রস্তত হয়ে পড়েন। পরে তিনি মেশিনে টিকিট কেটে দেন, তাতে ভাড়া লেখা ২০ টাকা।
ই-টিকিটিংয়ের দুর্বলতা স্বীকার মালিক সমিতির:
ই-টিকিটিং ব্যবস্থায় এসব অনিয়মের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ই-টিকেটিং ব্যবস্থায় কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে, এটা সত্যি। আমরা সেগুলো পর্যবেক্ষণ করছি। যাত্রীরা সঠিকভাবে টিকিট পাচ্ছে কি না তা মনিটর করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাত্রীদের কাছ থেকে যেন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা না যায় সে জন্যই ই-টিকিট চালু করা হয়েছে।’
টিকিটে দূরত্বের বিষয়টি কেন উল্লেখ নেই জানতে চাইলে মাহবুবুর রহমান বলেন, সফটওয়্যারে প্রতি কিলোমিটার ভাড়া দুই টাকা ৪৫ পয়সা হিসেবে যুক্ত রয়েছে। মোট দূরত্ব দিয়ে হিসাব করলে ভাড়ায় টাকার সঙ্গে পয়সা চলে আসবে। ওই ঝামেলা এড়াতেই কিলোমিটার উল্লেখ করা হয়নি। তবে বিআরটিএর নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ীই ডিভাইসে ভাড়া যুক্ত করা হয়েছে।
ই-টিকেটিংয়ের মেশিন বানিয়েছে যাত্রী সার্ভিসেস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এখন পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি মেশিন বাস মালিক সমিতিতে হস্তান্তর করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আরো চার হাজার মেশিন পাইপলাইনে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসফাক বলেন, ‘মালিক সমিতি যেভাবে মেশিন চেয়েছে আমরা সেভাবেই বানিয়ে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত তারা টিকিটে যাত্রার দূরত্বের হিসাব উল্লেখ করতে বলেনি।’
পরিবহন শ্রমিকদের মাসিক বেতনভুক্ত না করলে সুফল আসবে না:
পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, ‘রাজধানীর বাসগুলো এখন যেভাবে চলছে এই পরিস্থিতিতে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা টিকবে না। চালকরা আয় করবেন আর মালিক বাস ইজারা (লিজ) দিয়ে সব টাকা নিয়ে নেবেন, এমনটা শ্রমিকরা হতে দেবেন না। এ জন্য পরিবহন শ্রমিকদের আগে মাসিক বেতনের আওতায় আনতে হবে। বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি ফর্মুলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে সড়ক ও বাস ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরবে। তখনই ই-টিকেটিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।’