বন্ধ্যত্ব কাটিয়ে উত্তরণের পথে এগিয়ে চলুক শিক্ষাযাত্রা
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের শিক্ষাযাত্রার বিশেষ করে স্কুল শিক্ষার পথ অমসৃণ থেকে গেছে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ ধরে পরিক্রমণের চেষ্টা। বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে যাত্রা শুরু করলেও প্রতিবার মাঝপথে হোঁচট খাচ্ছে। সফল হতে পারেনি লক্ষ্যে পৌঁছতে। এই ধারাক্রমে ২০২৩-এর শুভ সূচনায় নতুন ধারার কারিকুলামে স্কুল শিক্ষায় অনেকটা বৈপ্লবিক সংস্কার প্রস্তাব দেখতে পাচ্ছি। সাধারণ বিচারে এই সংস্কারের রূপরেখা যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা আশাব্যঞ্জক। বিশেষ করে বিগত সময়ে শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে যেসব নিরীক্ষা চলেছে তা দেখে শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় সরাসরি সংশ্লিষ্ট অংশীজন যাঁরা, তাঁরা নানাভাবে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন। তবু অনড় থাকতে চেয়েছেন বিধায়করা। কিন্তু সাফল্য আনতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত শুভবুদ্ধির প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ যেভাবে দেখানো হয়েছে, সেখানে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে না পারলে সাফল্যের খোঁজ পাওয়া আবারও কঠিন হয়ে যেতে পারে।
২০১০ সালে একটি শিক্ষানীতি প্রণীত হয়। এর আলোকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের উদ্যোগে এর বাস্তবায়নের জন্য কমিটি গঠিত হয়েছিল। এ সময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ নামে মাধ্যমিক পর্যায়ে নতুন বই পাঠ্য করা হয়। এই সভায়ই গ্রহণ করা হয় সৃজনশীল নামের প্রশ্ন-উত্তরের অভিনব সিদ্ধান্ত। বিষয়টি নিয়ে কমিটির সদস্যদের মধ্যে কিছুটা মত-দ্বিমত ছিল। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ ঘটবে আশা করেছিলেন পদ্ধতিটির প্রস্তাবকরা। কিন্তু যে জটিলভাবে এর বিন্যাস করার চিন্তা ছিল, তাতে আশঙ্কা করা হয়েছিল, প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করতে না পারলে সৃজনশীলে উল্টো ফল ফলতে পারে। এভাবে চললে উৎসাহের সঙ্গে গাইড বইয়ের বিকাশ ঘটতে থাকবে। বাস্তবে হলোও তা-ই। শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে প্রচুর অর্থ খরচ হলেও বড়সংখ্যক শিক্ষক প্রশিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেননি। এভাবেই অসফল হলো সেবারের উদ্যোগ।
এনসিটিবিতে নানা কমিটি থাকার পরও অনেক ভুলের ছড়াছড়ি অনেকটা নতুন সংযোজন। এসব ভুলের তথ্য পেয়ে উচ্চ আদালত এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে তলবও করেছিলেন। এর রেশ না কাটতেই অতি সম্প্রতি নতুনভাবে ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তকের কথা ছড়িয়ে পড়ে গণমাধ্যমে।
এত সব সংকটের মধ্য দিয়ে এবার নতুন বছরের শুরুতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি বড় সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে স্কুল শিক্ষার যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষা পরিকল্পনায় আগের নীতি থেকে অ্যাবাউট টার্ন করা হয়েছে। আগে যেমন পরীক্ষার পর পরীক্ষা চাপিয়ে শিক্ষার্থীদের রোবট বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, এবার প্রচলিত ধারার পরীক্ষা অনেক কমিয়ে ফেলা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাই রাখা হয়নি। অন্য ক্লাসগুলোতে নানাভাবে মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। শিক্ষার্থী নিজেও নিজের মূল্যায়ন করতে পারবে। প্রচলিত পাঠ পরিকল্পনার বদলে পেশাভিত্তিক দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে কারিকুলাম সাজানো হয়েছে। এই সমুদয় কার্যক্রমের সফলতার জন্য বিবেচনা করা হয়েছে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিও।
ঘটনাক্রমে আমি ১৯৯৬ ও ২০১১ সালের এনসিটিবির মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ের কারিকুলাম, পাঠ্যসূচি তৈরি, গ্রন্থ প্রণয়ন ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভেতরের নানা দুর্বলতা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছে।
প্রথমত দেখেছি লেখক ও সম্পাদক নিয়োগের ত্রুটি। দলীয়করণ ও ক্ষমতাবানদের স্বেচ্ছাচারিতা বা কখনো অজ্ঞতা এই ক্ষেত্রটিকে অনেক ক্ষতি করছে। এসব বাস্তবতা দেখেই সম্ভবত ১৯৯৬ সালে কারিকুলাম ও গ্রন্থ প্রণয়নে লেখক-সম্পাদকদের যোগ্যতা নিরূপণের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে পয়েন্টের ভিত্তিতে বাছাই করা হয়েছিল। তাই দল-মত সেখানে গুরুত্ব পায়নি। ফলে সে সময়ের বইগুলোতে ভুলের অভিযোগ ছিল না। শুধু ইতিহাস বইতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অধ্যায়ে এসে লেখকদের অন্ধকারে রেখে আওয়ামী লীগ-বিএনপি রশি-টানাটানি করে ইতিহাস বিকৃত করার ভূমিকা রেখেছে। এরপর ধীরে ধীরে স্কুল শিক্ষার নীতিমালা তৈরিতে দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পেতে থাকে।
২০১১ সালের অভিজ্ঞতা একটু না বললেই নয়। কারিকুলামভিত্তিক পাঠ্যপুস্তক রচনার কিছু রীতি-পদ্ধতি রয়েছে। এখানে শিক্ষার্থীদের বই পড়ার শুরুতে বিষয়ঘনিষ্ঠ করার জন্য পাঠের উদ্দেশ্য, শিখনফল ইত্যাদি কিছু বিষয় যুক্ত করতে হয়। কোনো এক ক্লাসের গ্রন্থ রচনার সময় জানিয়ে দেওয়া হলো, বছরে ১০৬টি ক্লাস হবে। সেই হিসাবে পাঠ রচনা করতে হবে। সব স্তর পার হয়ে—অনুমোদিত হয়ে বই তখন মুদ্রণে যাবে। এমন সময় জানতে পারলাম, ক্ষমতাবান একজন ইতিহাসের অধ্যাপক এমন বড় রাষ্ট্রীয় কাজে তাঁকে যুক্ত না করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ক্ষমতাবান অধ্যাপক বহু গ্রন্থের লেখক হলেও স্কুল শিক্ষার কারিকুলামের সঙ্গে কখনো যুক্ত ছিলেন না। তাঁকে যুক্ত করা হলো সম্পাদক হিসেবে। তিনি লেখকদের এত দিনের পরিশ্রমে রচিত পাণ্ডুলিপির অনেক কিছু ফেলে দিলেন। কারিকুলাম নীতিমালার অনেক কিছুই মানা হলো না। উদ্দেশ্য, শিখনফল উচ্ছেদ করা হলো। ইতিহাস গ্রন্থে কিছু তথ্যবিভ্রাট ছিল। দীর্ঘ গবেষণায় তা সংস্কার করা হয়েছে। জানা না থাকায় লেখকদের ভুল মনে করে তা ঝেঁটিয়ে আগের ভুল তথ্য পুনঃস্থাপিত হলো। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এমন অভিভাবকহীনতা থাকলে পাঠ্যপুস্তক নির্ভুল হবে কেমন করে?
আশাব্যঞ্জক হলেও বর্তমানের এই নতুন কারিকুলামে কয়েকটি সংকট চোখে পড়েছে। এখানে বিজ্ঞান ও আইসিটি চর্চায় পেশাগত দক্ষতা তৈরির দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হলেও ইতিহাস-ঐতিহ্যের মতো মানবীয় বিষয়গুলো তেমন গুরুত্ব পায়নি। শিক্ষিত সচেতন মানুষমাত্রই মানবেন, জ্ঞানচর্চায় সমৃদ্ধ না হলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হয় না। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য এই বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে বলে আমরা আশা রাখি।
নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা রাখবেন শিক্ষকরা। নিকট অতীতে জটিল সৃজনশীল প্রশ্ন-উত্তরের জন্য প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছিল। এ ব্যাপারে সফল হয়নি মাউশি। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গাইড বই নির্ভর হতে হয়েছিল। যেভাবে এখন তড়িঘড়ি করে শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে শিক্ষক প্রশিক্ষণের জায়গাটি দুর্বল থেকে যাবে বলে আশঙ্কা করছি। এসবের পরিণাম যে ভালো হয় না এর অভিজ্ঞতা তো আমাদের রয়েছেই।
তবু আমরা প্রত্যাশার জায়গাটি বাঁচিয়ে রাখতে চাই। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে যদি আমরা এগিয়ে চলার পথে হাঁটতে পারি তাহলে নিশ্চয়ই সুফল ফলবে।