বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ
।। মোহাম্মদ মোকাররম হোসেন (আপন)।।
শতাব্দীর মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আধুনিক বাংলাদেশ তথা তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা বির্ণিমানে শিক্ষার একটি দর্শন প্রবর্তন করেছিলেন, যা বর্তমান সময়েও অমূল্য বলে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু জাতির দূর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের হৃদয় বিদারক ঘটনার পরে আজ অবধি শিক্ষা সংস্কারে এই অমূল্য দিকদর্শন পুরোপুরি স্টাডি হয়নি বা প্রতিষ্ঠার বৃহৎ আকারের কোন গবেষণা দেখা যায়নি। ভারতের জাতির জনক মাহাত্মা গান্ধীর শিক্ষা দর্শন প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক ইনস্টিটিউট গড়ে তুলে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে রয়েছি।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনের মূলে যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখবো “একটি বৈষম্যহীন শোষণহীন উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা” প্রবর্তনের জন্য আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রগতিশীল উৎপাদনমূখী দেশপ্রেমিক জনসমষ্টি সৃষ্টিতে শিক্ষাকে অভিযোজিতকরণের দিক নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে প্রথমে মনোযোগি হয়েছিলেন এই যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশের শিক্ষাকে পূনর্গঠনের। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “শিক্ষাই হবে মুক্তির হাতিয়ার”। এই মুক্তি হবে সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি, এই মুক্তি হবে মানবতার মুক্তি, এই মুক্তি হবে দরিদ্র শোষিত জনগণের মুক্তি, এই মুক্তি হবে দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি।
আর শিক্ষার মাধ্যমেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তাঁর আজন্ম লালিত স্বপ্নের সোনার বাংলা। তাইতো তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তদ্রুপ লিবারেল আর্টস (তথা সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি) বিষয়কেও গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। বর্তমান শিক্ষা বাজেটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি অধিক গুরুত্ব অনেকক্ষেত্রেই সমাজের ক্রমধারায় সংহতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করণের মাধ্যমে শিক্ষার মূল কাজ সামাজিক রূপান্তরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় লিবারেল আর্টসের বিষয়সমূহকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। তাই এক্ষত্রে সর্তকতার সাথে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান স্থাপনে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিক্ষাক্রমে লিবারেল আর্টসের বিষয়সমূহের সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব সময় চেয়েছেন এই দেশের মানুষ যেন খেয়েপরে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকতে পারে, আত্নমর্যাদা নিয়ে যেন বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। এই খেয়ে পরে বেঁচে থাকা আর আত্নমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সদ্য স্বাধীন দেশে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোও তিনি এদেশের প্রথম বাজেটে প্রতিরক্ষা খাত থেকেও বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন শিক্ষাখাতে। কারণ তিনি কেবল রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়কই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন শিক্ষা দার্শনিকও।
তিনি জানতেন শিক্ষার বিস্তার ও গুণগত মানের উন্নয়ন ব্যতীত আমাদের পক্ষে সামষ্টিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি ঘুণে ধরা সমাজকে বদলে দিতে চেয়েছেন। সেজন্য তিনি দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক। এই ডাকের মাধ্যেমে তিনি বাংলার সকল জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাই প্রবর্তন করেছিলেন সমাজতন্ত্র অভিমুখী গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার।
বেতন মওকুফ, বিনামূল্য পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, গণশিক্ষায় অর্থ আলাদাভাবে অর্থ বরাদ্দ, নারী শিক্ষার প্রসার, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ও জাতীয় গ্রন্থাগার গঠন,শিক্ষা কমিশন গঠন, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারীসহ বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপের মধ্যে দিয়েতিনি গণমুখী শিক্ষার দিকে জাতিকে ধাবিত করেছিলেন।কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উন্নয়ন, বিজ্ঞান, কৃষি, চিকিৎসা, বাণিজ্য, আইন, ললিতকলা, প্রভৃতি জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষার জন্য পৃথক বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর শিক্ষাদর্শনের মাঝেই আছে আত্ননির্ভরশীল, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার মূলমন্ত্র।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন অনুসরণ করেই তাঁর সুযোগ্য কন্যা দেশ রত্ন,জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দৃঢ়ভাবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কেবল সংখ্যাগত প্রবৃদ্ধিই ঘটেনি, গুণগত মানেরও উন্নয়ন ঘটছে তার প্রতিফলনই দেখা যায়। তবে এখনও যে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশে দেশে শত প্রতিকূলতা ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শিক্ষার উন্নয়নে তিনি প্রাথমিক শিক্ষার উপরে সর্বপ্রথম গুরুত্ব দিলেন। তিঁনি গ্রহণ করলেন প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার অবিস্মরণীয় সিদ্ধান্ত। ‘প্রাইমারী এডুকেশন টেকওভার এ্যাক্ট’এর মাধ্যমে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের চাকরি সরকারি করলেন, যাতে শিক্ষকদের মাঝে পড়ানোর আগ্রহ থাকে এবং কোন বিভেদ না থাকে। একইসাথে জাতি গঠনে তাঁরা ভ’মিকা রাখতে পারেন। বঙ্গবন্ধু সময় পেয়েছিলেন খুবই অল্প।
তাই হয়েতো তিনি মাধ্যমিক শিক্ষাকে একইভাবে জাতীয়করণ করে যেতে পারেননি, কিন্তু জাতি তাকিয়ে রয়েছে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে। যেহেতু বর্তমান সময়ে ঘোষিত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের জন্য গুণগত ও একীভূত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, সেহেতেু এদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে অবহেলিত এই মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের ন্যায় একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসছে। এক্ষত্রে অর্থ কোন বাধা হয়ে দাড়াবে না। কেননা শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয়কে বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন বিনিয়োগ হিসেবে, যার সুফল আজ আমরা ভোগ করছি।
বর্তমান বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শিল্পায়নের চর্তুথ স্তরে উন্নীত হয়েছে এবং সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা শিক্ষা পদ্ধতিকেও চতুর্থ স্তরে উন্নীত করেছে। বিশ্বের দরবারে জ্ঞান বিজ্ঞানে মাথা উঁচু করে দাড়ানোর প্রয়াস ঘোষিত হয়েছে, যা সময়ের বিবেচনায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও সাহসী পদক্ষেপ। কেননা এই শিল্প বিপ্লব-৪.০ এর সমান্তরাল শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে এডুকেশন ৪.০, যা শিক্ষাক্ষেত্রে শ্রেণি পঠন-পাঠন থেকে শুরু করে শিক্ষার প্রতিটিক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থাগ্রহণকে নিশ্চিত করে।
প্রকৃতপক্ষে, এডুকেশনের বিভিন্ন জেনেরেশান রয়েছে। শিক্ষা বিজ্ঞানে এই জেনারেশন সমূহ এডুকেশন ১.০, এডুকেশন২.০, এডুকেশন ৩.০ এবং এডুকেশন ৪.০ নামে পরিচিত। আধুনিক চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধাগ্রহণে অবশ্যই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এডুকেশন ৪.০ এ উত্তরিত হতে হবে, নতুবা ইনোভেটিভ, প্রডাকটিভ এবং যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় চৌকষ প্রজন্ম তৈরি অধরাই রয়ে যাবে। তাত্ত্বিকভাবে আমাদেরকে শিক্ষাব্যবস্থাকে এডুকেশন ৪.০ তে উত্তরণের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিখনে পাঁচটি আই (5 I’s) নিশ্চিত করতে হবে [যথা: Imbibing, Iterating, Interpreting, Interest,, এবং Innovating]।
এজন্য ভিন্নভাবে চিন্তণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের টেক্সটবইসমূহ এক্ষেত্রে বাধা তৈরি করছে। অনেকক্ষেত্রে এডুকেশণ ১.০ এর মুখস্তবিদ্যা নির্ভর শিক্ষাকেউৎসাহিত করছে। অপরদিকে রাতারাতি এডুকেশন ১.০ হতে এডুকেশন ৪.০ তে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব নয়। আমাদের বিদ্যালয় ব্যবস্থা এখনো অনেকক্ষেত্রে পুরোপুরি এডুকেশন ২.০ বাস্তবায়িত হয়নি, এমতাবস্থায় উচ্চ শিক্ষায় এডুকেশন ৪.০ প্রবর্তনের লক্ষ্য নির্ধারণ অসম্ভব না হলেও অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অর্থায়নে বাস্তবায়িত একটি প্রকল্প “স্কুল অন দ্যা ক্লাউড” এ এডুকেশন ৪.০ বাস্তবায়নের জন্য টেকনোলজির সাথে সাথে ‘Leadership for Change’ কে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে দেখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ন্যায় পরিবর্তনের নেতৃত্ব প্রয়োজন।এক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষা নেতৃত্বের জন্য বঙ্গবন্ধুর কর্ম ও শিক্ষা দর্শন অধ্যয়ন সহায়ক হতে পারে।
মনে রাখতে হবে, “শিক্ষা”- একটি মৌলিক অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যে কোন স্তরে শিক্ষকতা করলে তথা যেকোন বিষয়ে শ্রেণিতে পাঠদান করলেই শিক্ষা বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠা যায় না। এর জন্য ‘শিক্ষা’ নামক বিষয়টিতে বেসিক গ্রাজুয়েশন, মাস্টার্স, এমনকি পিএইচডি ডিগ্রী প্রয়োজন হয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ জরুরি। চিকিৎসাক্ষেত্রে যেমন একজন দন্তরোগ বিশেষজ্ঞকে দিয়ে ওপেন হার্ট সার্জারি করালে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ, তদ্রুপ শিক্ষাক্ষেত্রে নতুনত্ব প্রবর্তনে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারে যথাযথ বিশেষজ্ঞ ব্যতীত তথাকথিত শিক্ষা বিষয়ে ডিগ্রীবিহীন শল্য চিকিৎসকদের দিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন সরকারের শিক্ষা সংস্কারের সদিচ্ছাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
বিদ্যালয় শিক্ষার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে এনসিটিবি নিরলসভাবে কাজ করে গেলেও শিক্ষা বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞদের অভাবের কারণে এর সুফল খুবই কম পাওয়া যাচ্ছে, উপরন্তু শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই নিয়ে অযথা বিতর্কেও সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে দেখা যায়, শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিকায়নে যে সব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তার অধিকাংশেরই শিক্ষা বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ জনবল নেই। ফলে প্রচুর বিনিয়োগের পরেও প্রায়শই কাঙ্খিত ফললাভ সম্ভব হচ্ছে না। উন্নত বিশ্বে একজন ‘কম্পিউটার বিষয়’-এ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিকে অবশ্যই ‘কম্পিউটার প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও নীতিনির্ধারণে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু আমাদের দেশের মতো কখনোই শিক্ষা বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়াদির (যেমন মূল্যায়ন তথা পরীক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা পরিকল্পণা ইত্যাদি) ক্ষেত্রে নয়। কেননা এত ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হতে পারে।
যেমন হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের নামে ‘কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন’ প্রবর্তনের উদ্যোগে সৃষ্ট পিতামাতার আন্দোলন প্রশমনে কোন বিস্তৃত কনটেক্সটচুয়ালাইজড গবেষণা ব্যতীত “সৃজনশীল” নামে চালিয়ে দেয়ায়। যদিও এবারের শিক্ষা বাজেট কাগজে কলমে একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে, কিন্তু যোগ্য ব্যক্তিদের যোগ্যস্থানে না বসালে ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর একটি অদ্ভুত ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা ছিল। তিনি উপলব্দি করতে পারতেন, জনগণের প্রয়োজনকে, তিনি উপলব্দি করতে পারতেন কাকে দিয়ে কাজ হবে, এবং কীভাবে একটি লক্ষ্য পূরণ করতে হবে। তাইতো আমরা দেখি যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুর্নগঠনে যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনে সকল গতানুগতিক ধারার বাইওে গিয়েছেন। শিক্ষা সচিব হিসেবে আমলাতন্ত্রের বাইরে থেকে অধ্যাপক কবীর স্যারকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আবার আধুনিক শিক্ষা বির্ণিমানে বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-ই-খুদার নেতৃত্বে একদল শিক্ষা বিশেষজ্ঞকে নিয়োজিত করছিলেন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই বিস্তৃত আকারের বাজেট বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ অনুসরণের কোন বিকল্প নেই। যোগ্য নেতৃত্ব শিক্ষা প্রশাসনে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হলে প্রত্যাশিত শিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে না, উল্টো জাতি আরো পিছিয়ে পড়তে পারে। বঙ্গবন্ধু কন্যার সমস্ত প্রচেষ্টা বাস্তবায়নে যোগ্য শিক্ষা নেতৃত্বের কোন বিকল্প নেই।
শুধু বাজেটে বড় আকারের বরাদ্দ রাখলেই শিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে না। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা চিন্তা অনুযায়ী শিক্ষায় দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি, একই সাথে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে শিক্ষায় অপচয় ও দুনীর্তি বন্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ জরুরি। ১৯৭২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় শিক্ষা কমিশনের উদ্বোধনী ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শিক্ষা কমিশনের সদস্যগণকে বাংলাদেশের জনগণের বাঞ্জিত সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির জন্য পুনর্গঠিত নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে স্বাধীনভাবে তাঁদেও সুচিন্তিত পরামর্শ দানের আহবান জানান।
তিনি আরো বলেন, আমাদেও সীমিত সম্পদের কথা স্মরণ রেখে কমিশন শিক্ষার এমন এক দীর্ঘমেয়াদী রূপরেখা প্রণয়ন করবেন যা শিক্ষাক্ষেত্রে সার্থক ও সুদূরপ্রসারী সংস্কার সাধনে সাহায্য করবে। কেননা বঙ্গবন্ধু উপলব্দি করেছিরেন, যে কোন দেশের মানবসম্পদকে মানবপূঁজিতে পরিণত করে উন্নয়নের মূলধারায় অংশগ্রহণে সক্ষম নাগরিকে পরিণত করার জন্য প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী জনশক্তি পরিকল্পনা। আর এ পরিকল্পনার আওতায় দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ নাগরিক সৃষ্টির একমাত্র মাধ্যম বা কৌশল হলো ‘শিক্ষা’।
শিক্ষাকে বর্তমানে একটি লাভজনক বিনিয়োগক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ (গুণগত) বিনিময়মূল্য পাওয়া সম্ভব। তাই অপরিকল্পিতভাবে শিক্ষার বিকাশ না ঘটিয়ে যথাযথ পরিকল্পণার জন্য বর্তমান বাজেটের আলোকে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। কেননা বঙ্গবন্ধু চাইতেন জাতীয় উন্নয়নে দেশের সকল নাগরিকের সমঅংশীদারিত্বের সুযোগ সৃষ্টি হোক আর এটা হবে একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব।
তাই সবস্তরের শিশুদের আত্ম উন্নয়নে সমাজের মূল স্রোতধারার সাথে স¤পৃক্ত করার জন্য অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বৈষম্যহীন সোনার বাংলা গঠনে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এসবদিক বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ এর সংবিধানে একটি বৈষম্যহীন গণমুখী একইধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের বিষয়টি অর্ন্তভ’ক্ত করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পরে থমকে যায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সামাজিক ন্যায় বিচার প্রপঞ্চের ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ। আবার সময় এসছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। তাই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত একইধারার বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়ার এখনই প্রকৃত সময়।
আর বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বর্তমান বাজেটে যেমন বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, তেমনি পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা বৃত্তির হারও বৃাদ্ধিও প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও যেন শিক্ষা নিয়ে একটি কৌশলগত সমন্বিত আইনের অভাবে একটি শূণ্যতা বিরাজ করছে। যদিও মহামান্য হাইকোর্ট ২০১৭ সালে ‘Bangladesh Education Code’ নামে একটি কৌশলগত শিক্ষা আইন প্রণয়নের নির্দেশনা দিয়েছিলো। তাই এই বড় আকারের শিক্ষা বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুফল নিশ্চিত করতে যুগের দাবি অনুযায়ি একটি সামগ্রিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।
তবে একটা কথা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অবকাঠামো শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেমন গুরুত্বপূর্ণ,তেমনি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার্র্থীর সামর্থ্য ও যুগের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা। এক্ষেত্রে আমরা উন্নত বিশ্বের দেশগুলো থেকে ভীষণ পিছিয়ে আছি। এবারের বাজেটে শিক্ষার অন্যান্য ফ্যাক্টরগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হলেও শিক্ষাক্রমের বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। অথচ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষাক্রমগুলো ঢেলে সাজানোর নির্দেশনা এই বাজেটে থাকা দরকার ছিল। আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, আমাদের দেশের শিক্ষাক্রম পরিকল্পনা ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়েনর সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের বেশিরভাগই শিক্ষা বিশেষজ্ঞ নয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে যেখানে শিক্ষা ও গবেষণায় উচ্চতর ডিগ্রিধারীরা এই কাজে যুক্ত সেখানে আমাদের দেশে বিভিন্ন বিষয়ের উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্তরা এ কাজে যুক্ত।
মূল কথা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনের লক্ষ্য ছিলো বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রনয়ণ ও উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সকল শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করা। তাই আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিনীত অনুরোধ করছি জাতির জনকের শিক্ষা দর্শন বাস্তবায়ন করতে, মুজিব জন্ম শতবার্ষিকীকে স্মরনীয় করতে এবং স্বাধীনতার সূবর্নজয়ন্তীকে সামনে রেখে সকল শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের ঘোষনা দিয়ে উন্নত ও বৈষম্যহীন শিক্ষা নিশ্চিত করতে আপনার দুরদর্শি ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অপক্ষেয় গোটা জাতি।