বই পড়া : সে যুগে এ যুগে
ড. সুধাংশু শেখর রায়।।
বইয়ের আবিষ্কার এবং বই নিয়ে এখন বহু তর্কবিতর্ক শুরু হয়েছে। সভ্যতার শুরুতে যখন লেখার আবিষ্কার হয়েছে, যথাযথ মুদ্রণ প্রযুক্তির আবিষ্কার হয়নি, তখনই বই তৈরি করা শুরু হয়ে গেছে। হাতে তৈরি বিভিন্ন ধরনের কাগজ বা কাগজের মতো আধারে হাতে লিখে বই তৈরি করা হতো। কাজটা খুব কঠিন ছিল।
অর্থাৎ পড়ার জন্য বই সংগ্রহ করাটাই তখন খুব কঠিন কাজ ছিল। তাই অনেক কষ্ট করে হাতে তৈরি করা একটা বই-ই অনেকে পড়ত। বই বেচাকেনার দর্শনও সে সময় ছিল অর্থাৎ ‘Sell and production’ হিসেবে। তখন উৎপাদকের আগেই একজন ক্রেতা একজন বিক্রেতা বা ব্যবসায়ী বা উৎপাদকের কাছ থেকে নির্দিষ্টসংখ্যক বই কিনে ফেলতেন। তার পর বিক্রেতা বা উৎপাদক উদ্দিষ্টসংখ্যক বই তৈরি করে সরবরাহ করতেন।
এখন কিছুদিন আগে পর্যন্তও বই ক্রয়-বিক্রয়ের দর্শন পাল্টে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘Production and sell’ হিসেবে। অর্থাৎ বিক্রেতা বা উৎপাদক এখন আগেই একটা উদ্দিষ্ট সংখ্যা নির্ণয় করে বই ছাপিয়ে ফেলে। পরে ক্রেতার চাহিদা অনুসারে সরবরাহ বা বিক্রি করে। আর এটা হলো আধুনিক মুদ্রণ প্রযুক্তির ব্যবহার হাতের কাছে আছে বলেই।
মনে হয় সনাতনী ‘বিক্রি ও উৎপাদন’ দর্শন ফিরে আসছে ওয়েব প্রিন্টিংয়ের কল্যাণে। ওয়েব প্রিন্টিংয়ের কারণে প্রডাকশনের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কোয়ালিটি বই পেতে হলে আজকাল POD (Print on Demand) পদ্ধতিতে বই ছেপে সরবরাহ করা হচ্ছে।
চাহিদা অনুযায়ী এ পদ্ধতিতে খুবই সুনির্দিষ্ট ও কমসংখ্যক বই-ই সরবরাহ করা যায়। বড় প্রকাশক বা বিক্রেতার ক্ষেত্রে এটি কোনোমতেই ব্যবসায়িক উপযোগী ও লাভজনক মডেল নয়। যাই হোক, বহুসংখ্যক বই একবারে ছেপে বইমেলার মাধ্যমে অথবা সেলস্্ সেন্টার (যেটাকে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে লাইব্রেরি বলা হতো) থেকে বই বিকিকিনির সনাতনী প্রথাটি এখনো অনেকাংশেই চালু রয়েছে।
তবে ‘বই হাতের কাছে চলে আসবে’ এ দর্শনের থেকে ’বইয়ের কাছে যদি ভোক্তাকে নিয়ে যাওয়া যায়’ তা হলে ভোক্তা তার চাহিদামতো বইয়ের বাইরেও আরও বই-ই তার নজরে চলে আসবে। একুশে বইমেলা হচ্ছে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এতে করে বই পড়া ও বই কেনার আকাক্সক্ষা আরও বাড়বে। এ বিষয়েই বরং আমাদের মনোযোগ দেওয়া দরকার।
বইয়ের লেখাকে ধারণ করার মাধ্যম হচ্ছে মূলত কাগজ। পাঁচ শতাধিক বছর ধরে এটাই চলে আসছে। তবে মুদ্রণ প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের কারণে বইয়ের মাধ্যম কাগজের বদলে ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিনে অনেকটা আশ্রয় নিয়েছে। মানুষের হাতে কম্পিউটার এবং বিশেষ করে মোবাইল বা এই জাতীয় যন্ত্রের আধারেও এখন বই পড়া যাচ্ছে।
তবে সেটা কতখানি পড়া যাচ্ছে বা কতজনে পড়ছে সেটা নিয়ে একটি বিতর্ক আছে। পশ্চিমা দেশসমূহে বিশেষ করে আমেরিকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিশেষ করে তরুণরা ইলেক্ট্রনিক প্ল্যাটফর্মেই বই পড়ছেন। তবে ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে বই পড়ার সুবিধার যেমন, অসুবিধাও অনেক।
বর্তমান প্রজন্মের মানুষরা দীর্ঘ ভলিউমের কোনো বই পড়ার ক্ষেত্রে তাদের স্থৈর্য্য (Endurance) হারিয়ে ফেলছে। এর সঙ্গে কম্পিউটারে সারাদিন মাথা গুঁজে থাকায় এবং স্ক্রিন থেকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মির দিকে দীর্ঘ সময় চোখকে নিয়োজিত রাখায় অনেকেরই চোখসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর তার প্রভাব পড়ছে। সে তুলনায় মুদ্রিত বই পড়ায় সাধারণত কোনো শারীরিক প্রতিক্রিয়া নেই।
বরং মুদ্রিত বই পড়লে হৃদয়মন ও মস্তিষ্কের সঙ্গে পাঠকের যে আবেগীয় সংযোগ ও সম্পৃক্তায়ন ঘটে তার সুফল কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমরা দেখেছি, ২০১৯ সালে আমেরিকায় ইলেক্ট্রনিক প্ল্যাটফর্মে বই পড়ার হার কমে যাচ্ছে; কিন্তু করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ইলেক্ট্রনিকভিত্তিক বই পড়াশোনা আবার বেড়ে গিয়েছিল। এখন লক্ষ করা যাচ্ছে যে, অনলাইনভিত্তিক পড়াশোনার ফলে পড়াশোনায় ব্যাপক অবনতি হয়। একই সঙ্গে কিছু সময়ের জন্য লেখাপড়ায় নৈতিকতারও একটা পর্যায় পর্যন্ত অধঃপতন ঘটে।
করোনার ফলে সৃষ্ট এ প্রতিক্রিয়ায় বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীরা মুদ্রিত বইপত্র ম্যাটোরিয়ালস্ আর পড়তেই চাইছে না। ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতির সর্বনাশা এ পাশর্^প্রতিক্রিয়ার কারণে বই পড়ার আগ্রহটাই এখন কমে গেছে, অনেকে আগ্রহটাই হারিয়ে ফেলেছে। এ রকম পরিপ্রেক্ষিতে, পাঠকদের মুদ্রিত বই পাঠে যদি ফিরিয়ে আনা যায় তা হলে বই পড়ার সনাতনী প্রবাহ ও ধারাটা ফিরে আসবে।
আপনি কি চিন্তায় নিতে পারবেন যে, বাড়িতে বইয়ের কোনো শেলফ্ কিংবা আলমারি নেই, তার জাযগায় এক-দুটি মোবাইল যন্ত্রের পাতায় শত শত পাঠ (Content) আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এটা শুনতে যত রোমান্টিক লাগছে কিন্তু বাড়িঘরে বইবিহীন ধূসর পরিবেশটা আপনার মন-মানস ও পরিবেশ-পরিস্থিতিকে একটা ক্ষীণ অবয়ব বলে মনে হবে। আর সেজন্য মুদ্রিত বইয়েই ফেরাটা হবে আমাদের জন্য মঙ্গলজনক।
মুদ্রণমাধ্যম (বই) মানুষকে নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে বলে মত দিয়েছিলেন মার্শাল ম্যাকলুহান। অথচ তিনিই জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন বই লিখে। প্রযুক্তির অগ্রগতি এখন এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র মানুষকে প্রকৃতপক্ষে আরও একাকী ও নিঃসঙ্গ করে ফেলেছে। যন্ত্র মানুষকে দাস (Slave) বানিয়ে ফেলছে।
বরং আমরা দেখেছি বই-ই সমাজকে ধরে রাখতে পারে; উজ্জীবিত, উদ্বেলিত করতে পারে। মানুষকে তাই বইপাঠের জায়গায় ফিরে আসাটা জরুরি এখন। ইদানীং চারপাশের কিছু ঘটনা আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। কিছুদিন আগে বগুড়া-গাইবান্ধা এলাকার বই পড়ুয়া দুই যুবক-যুবতী নিখিল ও সান্তনা তাদের বিয়ের শর্ত হিসেবে ১০০টি বই মোহরানা হিসেবে দেওয়া-নেওয়া করে। আরেক খবরে দেখা গেল সম্ভবত উত্তরবঙ্গের একজন স্বশিক্ষিত দিনমজুর তার বাড়ির কাছে মুদ্রিত বইয়ের পাঠাগার তৈরি করেছেন।
সেখানে অনেক লোক বই পড়ছে। মুদ্রিত বই ছোঁয়া যায়, তাতে পাঠের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। তাই মুদ্রিত বই পড়ার অভ্যাস অব্যাহত রাখতে পারলে বর্তমান সময়ের মানুষের ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ ও মানবিকতাকে আরও উজ্জীবিত করা যাবে। বই তাই বিচ্ছিন্নতা নয়, মানুষকে একসূত্রে গ্রথিত করে।
লেখক-অধ্যাপক ড. সুধাংশু শেখর রায় : অনারারি অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
শিবা/জামান-১৭.০২.২০২৪