ফেসবুক || সামাজিক অপরাধের আতুড়ঘর
১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটির বেশি। ফেসবুকের একচ্ছত্র আধিপত্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগের ক্ষেত্রে ডাকঘরের ব্যবহার স্মৃতি রোমন্থনের পর্যায়ে চলে গেছে। সেইসঙ্গে পড়ালেখা, ব্যবসা-বাণিজ্য, দাপ্তরিক সভা, অনলাইনভিত্তিক চিকিৎসা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, চাকরির আবেদন, গবেষণা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনুশীলন ও বিনিময়, সামাজিক কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নসহ প্রায় সবক্ষেত্রেই ফেসবুকের তুমুল জোয়ার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত প্রদান এবং যে কোনো অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার ও ভূমিকা ক্রমশ বাড়ছে।
একই মুদ্রার দুই পিঠের মতো প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি ফেসবুক ব্যবহার করে করা হচ্ছে নানা অপরাধ। আইনের ভাষায় যা ‘সাইবার ক্রাইম’ বলেই পরিচিত। সাইবার বুলিং, ব্যক্তিগত ও অফিসিয়াল আইডি বা পেজ হ্যাক করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ড, অনলাইন ব্যবসা ও চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা, যৌন হয়রানি, পর্নোগ্রাফি, গুজবসহ আরো অনেক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে। আর সাইবার অপরাধের শিকার হওয়াদের অধিকাংশই নারী।
সাইবার অপরাধ নির্মূল করে ব্যবহারকারীদের ইতিবাচক স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)’, ‘পর্নোগ্রাফী নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২’ এবং ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’ ইত্যাদির বিভিন্ন ধারায় অপরাধীদের জেল ও জরিমানার মতো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান রেখেছে। ২০১৪ সালে চালু করা হয় ‘সাইবার নিরাপদ হেল্প ডেস্ক’। রয়েছে সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালও। তবে এক্ষেত্রে নানাবিধ কারণে অপরাধের সংখ্যার তুলনায় অপরাধী আটকের সংখ্যা কম। প্রচলিত আইন সম্পর্কে জনসাধারণের অজ্ঞতাই মূল কারণ। আবার অনেক ভুক্তভোগী বিশেষ করে নারী তথাকথিত সামাজিক বিড়ম্বনার ভয়ে সাইবার অপরাধের শিকার হলেও আইনের আশ্রয় নিতে অনাগ্রহী। অনেক সময় উপযুক্ত প্রমাণের অভাবেও প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
অবাধ তথ্য প্রবাহের সুযোগকে একশ্রেণির মানুষ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে ব্যবহার করছে। ফলে প্রযুক্তির ভুল ব্যবহারে ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে সাইবার অপরাধের পরিধি। তবে প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধ উত্তম। তাই ইন্টারনেট ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা নিশ্চিত করা গেলে বিড়ম্বনা ও অপরাধ শুরুতেই প্রতিরোধ করা যায়। এক্ষেত্রে অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তিগত ছবি ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদান না করা, আইডির গোপন নম্বর শক্তিশালী করা ও একান্তই গোপন রাখা, অপরিচিত কারো সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় আলাপ বা সখ্য না গড়া, বাছবিচারহীনভাবে গ্রুপ বা কোনো লিংকে প্রবেশ না করা, লটারি বা উপহার সংক্রান্ত তথ্য এড়িয়ে যাওয়া, পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারে সতর্ক থাকা, অশ্লীল ও রাষ্ট্রবিরোধী তথ্য লাইক বা শেয়ার না করা ইত্যাদি ব্যাপারে সবার সচেতন থাকা উচিত।
ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি প্রয়োজন কিশোর বয়সীদের প্রতি অভিভাবকদের নজরদারি। দুর্ভাগ্যক্রমে অনলাইনে প্রতারণা বা হয়রানির শিকার হলে প্রমাণপত্র (ছবি, স্ক্রিনশট, ভিডিও, তথ্য) নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ থানার পুলিশকে জানানো উচিত। এক্ষেত্রে আইডি ডিলিট করাটা বোকামি। কারণ তখন অপরাধীকে ধরা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে যায়। সাইবার অপরাধ দমন ও নির্মূলে সরকারের কার্যকর ভূমিকা অপরিহার্য। সম্ভাব্য সকল মাধ্যম ব্যবহার করে ইন্টারনেটের যথাযথ ব্যবহারে জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে অমিত সম্ভাবনার সুফল উপভোগ করে দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য উন্নয়নে অনলাইনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের পাশাপাশি সাইবার অপরাধকে সমূলে ধ্বংস করা আবশ্যক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ও ইতিবাচক ব্যবহারের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা সময়ের দাবি।