ফুলপরীর দেখানো পথ
জোবাইদা নাসরীনঃ ফুলপরী খাতুনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচয় নেই। তিনি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী। শুধু শিক্ষার্থী বললে হয়তো কম বলা হবে। কারণ ইতোমধ্যে তিনি আর দশটি শিক্ষার্থীর চেয়ে নিজের অবস্থান আলাদা করেছেন। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ফুলপরী। তাঁর এই দাঁড়িয়ে থাকার মধ্য দিয়ে আমি আমার অনেক নারী শিক্ষার্থীর চেহারা দেখতে পাচ্ছি। কেন পাচ্ছি, সে প্রসঙ্গে আসব একটু পরে।
গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জেনেছি, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া ফুলপরী খাতুন। তাঁকে বিবস্ত্র করা হয় এবং সেখানে চার ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনার পর সেই ছাত্রী চুপচাপ না থেকে এর বিচার চেয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের একজন নেত্রী এবং তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন।
অভিনন্দন ও স্যালুট ফুলপরীকে। তিনি সাহস করে এগিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোতে নিপীড়নের ঘটনা গণমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়। যার কারণে এটি মনে হওয়া স্বাভাবিক- ছাত্রী হলগুলোতে এ ধরনের নিপীড়ন হয় না এবং সেখানকার পরিস্থিতি ভিন্ন। অনেকেই হয়তো ভাবেন, ছাত্রী হলের আবাসিক শিক্ষকদের কোনো ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয় না।
আসলে ছাত্রীদের আবাসিক হলগুলোতেও চলে নানা ধরনের নিপীড়ন। সবটাই যে শারীরিক, তা নয়। প্রতিটি ছাত্রী হলেই 'পলিটিক্যাল রুম' বলে কিছু কক্ষ থাকে। সেখানে ক্ষমতাসীন সংগঠনের নেত্রীরা তাদের পছন্দমতো ছাত্রীদের তোলে। হল প্রশাসনকে তোয়াক্কা না করে এসব ছাত্রী তোলা হয়। বিশেষ করে যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার ক্ষেত্রে হলে থাকা ছাড়া বিকল্প থাকে না, তারা এলাকার নেতানেত্রীদের অনুরোধ করে হল বা 'পলিটিক্যাল রুম'-এ ওঠে। তবে তখনও তারা বুঝে উঠতে পানে না, তাদের জন্য সেখানে কী কী অপেক্ষা করছে। রাজনৈতিক রুম কিংবা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের রেফারেন্সে হলে ওঠা ছাত্রীদেরও ছাত্রদের মতো হল ও বাইরের মিছিল-মিটিংয়ে নিয়মিত অংশ নিতে হয়। তখন এমন অবস্থা হয়, এই ছাত্রীরা অন্য রুমে যেতে পারে না। গেলেও নেত্রীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং তাদের কথামতো চলতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ কম হয়। অনেকেই মুষড়ে পড়ে। ভয়ে কারও কাছে কিছু বলতে পারে না, আবার কেউ কেউ এ অবস্থাকে মেনে নিয়ে বেপরোয়া ক্ষমতাচর্চায় নিজেকে হাজির করে। কারণ, সে জেনে যায়- এটি একটি ভয়াবহ বৃত্ত। এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না। আরও জেনে যায়- প্রশাসন থেকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতানেত্রী শক্তিশালী। তাই তারা ভয়ে হোক আর সয়েই হোক, তাদের কথা শোনে কিংবা শুনতে বাধ্য হয়।
তারা জানে, তাদের আরও তিন-চার বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে হবে। নির্যাতকদের বিরুদ্ধে প্রশাসনে বিচার দিলে কোনো লাভ হবে না। উল্টো আরও নিপীড়নের শিকার হতে হবে। ছেলেদের হলগুলোর এমন অভিজ্ঞতা মেয়েরা প্রতিদিন শোনে এবং আরও ভয় পায়। তাই নিজেদেরটা আর বলার সাহস পায় না।
এবার আসি প্রশাসনিক ব্যর্থতা প্রসঙ্গে। এসব নিপীড়নের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা হল প্রশাসনের ব্যর্থতা নিশ্চয় আছে। সেগুলো নিয়ে কথা যে হয় না, তা নয়। তবে এটি আমলে নেওয়া হয় না। ছেলেদের হলগুলোতে বেশিরভাগ কক্ষের সিটের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের থাকে। মেয়েদের হলগুলোতে ততটা না হলেও ক্ষমতাসীন দলীয় নেত্রীরাও ক্ষমতা ব্যবহার করে কিছু কক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাদের চাওয়া-পাওয়ার মতো করেই হল চালানো হয়। তাদের খুশি রাখাই হয়ে পড়ে প্রশাসনের বড় কাজের একটি।
কেন এমন করেন প্রশাসনিক শিক্ষকরা? ভয়ে করেন? গদি ঠিক রাখার জন্য? অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানোর জন্য? নাকি অপমানের ভয়ে?
তবে কোনো কোনো শিক্ষক ওপরের পদ পাওয়ার জন্য নেতানেত্রীদের খুশি রাখেন। কেন একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থী নেতাকে খুশি রাখতে আপনি আপনি করে, জি ভাই জি ভাই বলে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয় (এমন নয়- তিনি সব শিক্ষার্থীকে আপনি করে সম্বোধন করেন)? কোনো কোনো উপাচার্য ছাত্রনেতাদের জন্য অনুষ্ঠানে আধা ঘণ্টা-এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। এমন উপাচার্য আছেন বা ছিলেন, যিনি আরেকটু তোষামোদে ছাত্রনেতাকে 'স্যার' ডাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপাচার্যের পাশে ছাত্রনেতা বা নেত্রী বসে থাকে। অনেক শিক্ষকই বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কোনো কোনো শিক্ষক নিজে আসন ছেড়ে দিয়ে ছাত্রনেতাকে বসতে অনুরোধ জানান। সবই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র। আমরা এগুলো নিয়ে টুঁ শব্দ করি না। আমরা শুধু ছাত্রনেতাদের দোষ দিয়ে নিজেদের 'মহৎ' ভাবার চেষ্টা করি। কিন্তু ভাবি না, ক্ষমতাসীন সংগঠনের নেতানেত্রীদের এই পর্যায়ে আনতে আমাদের ভূমিকা কতখানি? আমরা সবাই আসলে কমবেশি এ প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছি।
এত নিপীড়নের শঙ্কাকে পাশ কাটিয়ে ফুলপরী যে বিচার চাওয়ার সাহস দেখিয়েছে- সেটিই সবচেয়ে বড় পাওয়া। কারণ, এখন এ রকম চিত্র সামনে আসা কাঙ্ক্ষিত হলেও দুর্লভ। ফুলপরী অনেকটাই পথ দেখিয়েছে। তার সঙ্গে আছেন অনেক শিক্ষক এবং তাঁর অভিভাবকও। ফুলপরীর এই প্রতিবাদ আমাদের তোষামোদ এবং ভয়ের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ আঘাত। জানি না, তাতে কার কী পরিবর্তন হবে! তবে এটুকু ভাবতে হবে- সব মানুষের মধ্যে প্রতিবাদের শক্তি আছে। ফুলপরী সেই প্রতিবাদের গোলকই নিক্ষেপ করেছে।
জোবাইদা নাসরীন :শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২২/০২/২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়