প্রাথমিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ অধিদপ্তর কাদের জন্য?
মাছুম বিল্লাহঃ কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি), প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (পিটিআই) এবং জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)-কে একত্র করে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ নামে একটি অধিদপ্তর স্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। এর ফলে দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ঐতিহ্যবাহী এই তিন শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি ঘটবে। এমন খবরে প্রাথমিক শিক্ষার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছুটা সন্দেহ, কিছুটা অস্থিরতা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে।
এই তিনটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে হঠাৎ বিলুপ্তি ঘটিয়ে নতুন একটি অধিদপ্তর সৃষ্টির বিষয়কে ভালো চোখে দেখছেন না শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষার কর্মকর্তাদের ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ করে আমলাদের পুনর্বাসনের জন্য নয়া এই অধিদপ্তর গঠন করা হচ্ছে। এতে বর্তমানে থাকা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বিভেদ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। তবে, এর পক্ষে-বিপক্ষে আরও কথা আছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে তিন ধরনের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষকদের কাছে তিন ধরনের নির্দেশনা যায়। আবার প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা নির্দেশনা দেয়। এতে অনেক সময় বিদ্যালয় ও শিক্ষকরা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যান। প্রশিক্ষণের জন্য গঠিত নতুন অধিদপ্তর থেকেও যদি এ রকম ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশনা যায়, তাহলে তো অবস্থার পরিবর্তন বা উন্নয়ন হয়েছে বলা যাবে না। যদি ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশনা যায় তাহলে বলতে হবে, এগুলো বাদ দিতে হবে। আর প্রশিক্ষণ অধিদপ্তর থেকে যদি এক নির্দেশনায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সবকিছু জানানো হয় তাহলে সেটিকে ভালো উদ্যোগ বলা যায়। তবে, সময় বলে দেবে বিষয় কোনদিকে ধাবিত হবে।
জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)-এর মহাপরিচালক এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি, হওয়ার কথাও নয়। কারণ তিনি সরকারি কর্মকর্তা। আর বিষয়টি হচ্ছে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের। সিদ্ধান্ত হলে সেটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের। ঢাকা পিটিআইয়ের সুপারিনটেনডেন্ট এ ব্যাপারে বলেন, কর্তৃপক্ষ কেন এমনটি করতে চাচ্ছে তা বলার সময় আসেনি। তবে প্রশিক্ষণ অধিদপ্তরের গঠন নিয়ে তাদের দুই রকম চিন্তা আছে। এর একটি হচ্ছে বর্তমানে থাকা তিন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান একত্র করার ফলে যদি পদ-পদবি বাড়ে তাহলে মন্দ হবে না। অন্যদিকে নতুন অধিদপ্তর সৃষ্টি করে তার মাথায় আমলাদের বসিয়ে দিলে বিষয়টি অন্যরকম মাত্রা পাবে। কাজেই আরও ক’দিন না গেলে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। তবে, প্রাথমিক শিক্ষায় যেহেতু আলাদা কোনো ক্যাডার নেই, আবার শিক্ষা ক্যাডারের (কলেজ পর্যায়ের) শিক্ষকদেরও প্রাথমিক শিক্ষা অধিপ্তরের কোনো কর্মকা-ে নিয়োগ দেওয়া হয় না তার অর্থ হচ্ছে নতুন পদ সৃষ্টি এবং সেগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হবে। সেটি খুব ভালো সিদ্ধান্ত নয়। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চতুর, অল-রাউন্ডার বলে ধরা হতো, সেটি আর আগের মতো নেই বিভিন্ন কোটার সুবাদে এবং দেশে শিক্ষার অবনতির কারণে। তারপরেও তারা অনেক দক্ষ কিন্তু সেই প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা করা কখনই শুভ নয়। চোখের ডাক্তার যত বড়ই হোক তারা দ্বারা যেমন দাঁতের চিকিৎসা হয় না ঠিক তেমন। কিন্তু বিষয়টিতে আমরা কোনো গুরুত্ব দিচ্ছি না কারণ ‘ও তো বাচ্চাদের পড়াশোনা।’ অথচ বাচ্চাদের পড়াশোনাই বেশি কঠিন, এটি একটি বিশেষায়িত দিক যা সাধারণ বা প্রশাসনের লোক দ্বারা করানো ঠিক নয়।
পত্রিকা সূত্রে জেনেছি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ৪ জানুয়ারি জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বলেছে যে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গত ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ অনুষ্ঠিত মাসিক সভায় উপজেলা রিসোর্স সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমিকে একত্র করে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট সৃষ্টির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এমতাবস্থায় ইউআরসি, পিটিআই এবং নেপকে একত্র করে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ অধিদপ্তর সৃষ্টির পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব আগামী দশ কর্মদিবসের মধ্যে পাঠাতে হবে। বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের ইউআরসি থেকে প্রশিক্ষণ হয়। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ডিপিইনএড প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে জেলা সদরে অবস্থিত পিটিআই। আর প্রশিক্ষণের সবকিছুর দেখভাল করে ময়মনসিংহে অবস্থিত নেপ। আবার ক্ষেত্রবিশেষে প্রশিক্ষণের বিধান দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরও। নয়া বিধানমতে, প্রাথমিকের শিক্ষা প্রশিক্ষণ নামে অধিদপ্তর সৃষ্টি হলে বর্তমানে থাকা কর্মকর্তাদের কী হবে? উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিয়ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে কী হবে? এসব বিষয় খুব স্পষ্ট নয়। কোনো কোনো শিক্ষাবিদ বলেছেন, বর্তমান প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোকে জোরদার না করে নতুন অধিদপ্তরের জন্ম দেওয়ার বিষয়টি খুব বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত বলে মনে হচ্ছে না। অবশ্য তিন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশনা যাওয়ার ব্যাপারে কিছু শিক্ষাবিদ প্রশিক্ষণের জন্য নবসৃষ্ট অধিদপ্তরকে ভালো বলে মন্তব্য করেছেন।
এই তত্ত্বের জনক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক সচিব বলে কেউ কেউ জানিয়েছেন। তিনিই নাকি বর্তমানে থাকা তিনটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে একত্র করে প্রশিক্ষণের নামে একটি অধিদপ্তর সৃষ্টির বিষয়টি চূড়ান্ত করেন। তার চিন্তাকে আমরা সম্মান জানাই। তার দেখানো পথেই মন্ত্রণালয়ের বর্তমান প্রশাসন নতুন অধিদপ্তর গঠন করার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। নতুন অধিদপ্তরে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা মহাপরিচালক হবেন। একই মানের আরেকজন কর্মকর্তা অতিরিক্ত মহাপরিচালক হবেন। যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা পরিচালক পদের জন্য পদায়ন পাবেন। প্রায় একই ধরনের পদ্ধতি বর্তমানেও বিদ্যমান অর্থাৎ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন। শিক্ষা বিভাগে শিক্ষা প্রশাসন বলে একটি কথা ও ব্যবস্থা বিদ্যমান। সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন করার বিষয়টি খুব বিজ্ঞানসম্মত নয়। এটি পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। যে পরিবর্তনের কথা শোনা যাচ্ছে বা প্রস্তাব চলছে তার পেছনের কারণ তো এটি বলেই মনে হয় যে, প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের কর্মস্থলের প্রসারণ ও তাদের পদায়ন। এতে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য যতটা না এই বন্দোবস্ত তার চেয়ে বেশি হচ্ছে প্রশাসন ক্যাডারের সুবিধা বাড়ানোর পাঁয়তারা। প্রশাসন ক্যাডারের অধিকাংশ কর্মকর্তাই সাধারণত স্মার্ট ও চটপটে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন একটি জটিল ও বিভাগীয় বিষয় নিয়ে গঠিত। সেখানে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রবেশ খুব একটা শিক্ষাবান্ধব নয়। বর্তমানে নেপ, পিটিআই এবং রিসোর্স সেন্টারের কর্মকর্তারা কোথায় কীভাবে প্রশিক্ষণ অধিদপ্তরে সংযুক্ত হবেন তার রূপরেখা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। নেপে বর্তমানে মহাপরিচালক ও পরিচালক পদে আমলারা পদায়ন পাচ্ছেন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে আমলারা রয়েছেন। নবগঠিত প্রশিক্ষণ অধিদপ্তরে আমলারা পদায়ন পাবেন। সম্ভবত এসব কারণেই বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। যদি প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার উন্নয়নের জন্য, শিশুদের উন্নয়নের জন্য বিষয়টি করার পরিকল্পনা হতো তাহলে শিক্ষাবিদদের কেউই প্রশ্ন তুলতেন না। প্রশিক্ষণ অধিদপ্তরের জন্য রাজধানীর মিরপুরে একটি ভবনও নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানা যায়। তার মানে কাজ অনেকদূর এগিয়েছেও বলা যায়।
দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর এর মূল ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। দক্ষ প্রাথমিক শিক্ষক তৈরি করতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পিটিআই। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১২টি জেলায় আগে পিটিআই ছিল না। বর্তমানে দেশের প্রতিটি জেলাতেই পিটিআই আছে। রাষ্ট্রীয় এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। প্রশিক্ষণ উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চেয়ে অনেকটাই সমৃদ্ধ করা হয়েছে যা প্রশংসা পাওয়ার উপযুক্ত। কিন্তু শুধু আমলাদের পদায়নের জন্য যদি তিন প্রশিক্ষণ বিভাগকে একত্র করে আলাদা প্রশিক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা করা হয় সেটিতে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবারই আপত্তি থাকবে। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য, সেটি হচ্ছে আমলারা কোনো বিষয়ে মন্ত্রী-জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শ দিতে পারেন, কিন্তু শিক্ষক প্রশিক্ষণের মতো বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়নের দিকে আগানো আমাদের পুরো ব্যবস্থার দুর্বলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সচিব মহোদয় বিষয়টি অবলোকন করে এ ধরনের সিদ্ধান্তের কথা বলেছেন, আলোচনা করেছেন যেটি করার কথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর। সেটি কিন্তু আমরা এখানে দেখতে পাইনি।
লেখক: শিক্ষাবিষয়ক গবেষক ও কলাম লেখক
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১২/০৭/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়