প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতে ১০ পদের দুর্নীতি
ঢাকাঃ সব শিশুর জন্য সমতাভিত্তিক মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং শক্তিশালী ও ন্যায়সঙ্গত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) গ্রহণ করা হয়েছিল। এমন গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের বেলায় পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে সরকারের শিক্ষা নিরীক্ষা অধিদপ্তর। কর্মসূচি চালুর প্রথম বছরই এমন দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে, যা সম্প্রতি প্রকাশিত অধিদপ্তরটির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মসূচির প্রথম এক বছরেই (২০১৮-১৯) ২৬ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম করা হয়েছে। ৩৮ হাজার কোটি টাকার এই মেগা প্রকল্পে বাকি সময়গুলোতে কী পরিমাণ অনিয়ম হয়েছে, তা এখনও জানা যায়নি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে অনিয়ম-দুর্নীতির ১০টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছেন এই প্রতিবেদক।
জানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) অধীনে ২০১৮ সালের জুন মাস থেকে পিইডিবি-৪ কর্মসূচি শুরু হয়, যা শেষ হয় ২০২৩ সালের জুলাই মাসে। এতে অযৌক্তিক পরিকল্পনায় অর্থ বরাদ্দ এবং কাল্পনিক খরচ, খরচের ভাউচার না থাকা, সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেওয়াসহ নানা রকমের অনিয়ম করা হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জবাবদিহির অভাবেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পে এমন দুর্নীতি করা সম্ভব হয়েছে। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।
নিরীক্ষা প্রতিবদেন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রথম বছর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল অ্যাটেনডেন্স যন্ত্র ক্রয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) কর্তৃক অযৌক্তিক ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ পরিকল্পনা ও নির্দেশনার কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৮ কোটি ৭৩ লাখ এক হাজার ৮৪০ টাকা। আর যন্ত্রটি ক্রয়ের জন্য গৃহীত অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১০ কোটি ৩৪ লাখ এক হাজার ৬৪৫ টাকা। অগ্রিম গৃহীত অর্থের সমন্বয় ভাউচার উপস্থাপন না করায় ব্যয়ের সঠিকতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি ১ কোটি ৩৫ লাখ ৩৩ হাজার ৯২০ টাকা। চুক্তি অনুযায়ী ত্রুটিপূর্ণ বই-এর মূল্য কর্তন না করায় আর্থিক ক্ষতি হয় ২ কোটি ৩৬ লাখ ৩২ হাজার ৯২১ টাকা। বই সরবরাহকারীদের ওপর বিলম্ব জরিমানা আরোপ না করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয় ৩৪ লাখ ৮ হাজার ৪৪২ টাকা।
অনিয়ম দুর্নীতির বাকি পাঁচটি ক্ষেত্রে হচ্ছে- যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সর্বনিম্ন দরদাতাকে নন-রেসপনসিভ দেখিয়ে কাজ না দেওয়ায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি করা হয় ১ কোটি ১৭ লাখ ৭১ হাজার ৭২১ টাকা। রেসপনসিভ নিম্নদরদাতাকে অযোগ্য ঘোষণা করে উচ্চ দরদাতার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করায় আর্থিক ক্ষতি হয় ৪৩ লাখ ৬১ হাজার ৪৭৭ টাকা। চুক্তি-বহির্ভূত খাতে ভাতা পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয় ২৮ লাখ ৪৭ হাজার ৮০০ টাকা। আয়কর ও ভ্যাট কম কর্তন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্তন না করায় সরকারের ক্ষতি হয় ৯৪ লাখ ৫৯ হাজার ১৩৪ টাকা। বিল সমন্বয়ে একই ক্রয় ভাউচার বারবার ব্যবহার করে কাল্পনিক খরচ দেখিয়ে আত্মসাৎ হয়েছে ৭ লাখ ২১ হাজার ৬৩৫ টাকা। অর্থাৎ এক অর্থবছরে ২৬ কোটি ৪ লাখ ৪০ হাজার ৫৩৫ টাকা সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
পিইডিপি-৪ কর্মসূচির অনিয়ম-দুর্নীতির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, অডিটের এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আমি জানি না। খোঁজ নেব। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে দায়ীদের বিরুদ্ধে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেব।
এ প্রসঙ্গে সরকারি অর্থ যথাযথ প্রক্রিয়ায় বরাদ্দ এবং ব্যয়ে জবাবদিহি না থাকায় দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে। তারা সুপারিশও করে দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। কিন্তু সে সুপারিশ কর্তৃপক্ষ কখনো বাস্তবায়ন করে না। যখন জবাবদিহি থাকে না তখন কেউ দুর্নীতি করতে আর ভয় পায় না।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, কর্মসূচির প্রথম বছরে (২০১৮-১৯) প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ২০১৯ সালের মে মাসে সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোকে ডিজিটাল বায়োমেট্রিক হাজিরা যন্ত্র কেনার জন্য নির্দেশনা দেয়। সে আলোকে মাঠপর্যায়ের দপ্তরগুলোকে বাজেট বরাদ্দ প্রদান করে। জুন মাস পর্যন্ত অর্থ উত্তোলন করে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ডিভাইস কিনে নেয়। তবে এর চার মাস পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দিষ্ট টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন দিয়ে যন্ত্রগুলো কেনার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু যন্ত্রগুলো আগেই ক্রয় করে ফেলা হয় এবং তা কাজেও লাগেনি। এতে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের দুর্বলতা প্রকাশ পায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের।
নিরীক্ষার তথ্যে উঠে এসেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাধারণত চার থেকে সাতজন শিক্ষক থাকেন। এদের জন্য এ ধরনের ডিজিটাল হাজিরা যন্ত্র ক্রয়ের সিদ্ধান্ত অর্থ ব্যয়ের দিক থেকেও যথার্থ নয়। তাই এ কাজে বাজেট বরাদ্দ এবং ক্রয়কার্যের দুটোই সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক এবং ফলত বড় অঙ্কের সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে। এতে দেখা যায়, স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ওয়্যারলেস রাউটার না থাকায় ইন্টারনেট সংযোগের অভাবে ক্রয়কৃত ডিভাইসটি অকার্যকর রয়েছে।
কর্মসূচির অধীনে বই বিতরণ উৎসব-২০১৯ উদযাপনের জন্য ৩৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা, জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক-২০১৮ এবং জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৯ এর জন্য ১৩ লাখ ৮৩ হাজার ৪২০ টাকা অগ্রিম বরাদ্দ দেন ডিপিই পরিচালক (প্রশাসন)। আন্তঃপ্রাথমিক বিদ্যালয় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা-২০১৯ উদযাপনের জন্য পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) ৮২ লাখ ৯০ হাজার ৫০০ টাকা অগ্রিম হিসেবে গ্রহণ করেন। এসব অগ্রিম অর্থ ব্যয়ের কোনো বিল-ভাউচার পাননি নিরীক্ষা কর্মকর্তারা।
নিরীক্ষার তথ্যে উঠে এসেছে, কর্মসূচির অধীনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এনসিটিবির চুক্তি অনুযায়ী ত্রুটিপূর্ণ বইয়ের দাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কর্তন করা হয়নি। কার্যাদেশের শর্ত অনুযায়ী, ১০ শতাংশ জামানত এনসিটিবি জরিমানা করতে পারে। এছাড়া চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বই সরবরাহ করেনি কিছু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। উভয়ক্ষেত্রেই জরিমানা না করে অর্থ পরিশোধ করা হয়, যা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। এছাড়া বই সরবরাহের জন্য দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সর্বনিম্ন দরদাতাকে নন-রেসপনসিভ দেখিয়ে কাজ দেওয়া হয়নি। বরং উচ্চ দরদাতার সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর ‘সেকেন্ড চান্স এডুকেশন প্রোগ্রামের’ জেলা কার্যালয়ে চুক্তি-বহির্ভূত খাতে ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত বেতন পরিশোধের কথা থাকলেও তাদের চুক্তির অতিরিক্ত হিসেবে যোগাযোগ ও যাতায়াত ভাতা প্রদান করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং এর আওতাধীন বিভিন্ন উপজেলা অফিসে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আয়কর ও ভ্যাট কর্তন করা হয়নি। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কম কর্তন করা হয়েছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী না থাকাকে দায়ী করেছেন শিক্ষা নিরীক্ষা অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, সরকারি অর্থ আদায়ে ও ব্যয়ে প্রচলিত বিধি-বিধান পরিপালন করা হয়নি। পূর্ববর্তী নিরীক্ষার সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন না করার কারণে একই ধরনের অনিয়ম বারবার হচ্ছে। এর পুনরাবৃত্তি যেন না হয়- সে জন্য দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের মনোনিবেশ করা উচিত বলে মনে করেন অডিট অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। সূত্রঃ দৈনিক আমাদের সময়
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৫/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়