প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও ব্যয়বহুল কিন্ডারগার্টেন
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
ঢাকায় যোগাযোগ পেশায় নিয়োজিত আতিউর রহমান। পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন মিরপুর এলাকায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ও শিক্ষার মানের কথা বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চার বছরের ছেলেকে ভর্তি করাবেন ভালো কোনো কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। এজন্য তিনি ঘুরেছেন আশপাশের মোটামুটি পরিচিত ৮-১০টি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। তবে ছেলেকে ভর্তি করাতে পারেনি সেগুলোর কোনোটিতে।
আতিউর জানান, ইংলিশ মিডিয়াম পরিচয়ধারী ঢাকার স্বনামধন্য এই কিন্ডারগার্টেনগুলোতে প্লে শ্রেণিতেই ভর্তি করাতে লাগে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। দ্বিতীয় সারির স্কুলগুলোতে ছাত্র ভর্তিতে ফরমের মূল্য, ভর্তি ফি ও অন্যান্য ফি মিলে প্রথম মাসেই গুনতে হয় ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। এছাড়া, রাজধানীর পাড়া মহল্লায় গড়ে ওঠা অপরিচিত সেমি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে প্লে শ্রেণিতে ছাত্র ভর্তি করাতে খরচ হয় ৩০-৬০ হাজার টাকা।
জানা গেছে, ঢাকার কিন্ডারগার্টেগুলো ভর্তি ফি বাবদ যে অর্থ গ্রহণ করছে সে পরিমাণ অর্থ লাগে না প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তিতে। ঢাকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান ও বিষয়ভেদে ভর্তি ফি ও অন্য ফি মিলে শুরুতে লাগে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। প্রতি মাসে টিউশন ফি দিতে হয় ৮-১২ হাজার টাকা।
কিন্তু বহুল পরিচিত কিন্ডারগার্টেনগুলোতে প্লে শ্রেণীতে ভর্তিতেই লাগছে লাখ লাখ টাকা। এছাড়া, প্রতিমাসে টিউশন ফি বাবদ ১৫-২০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে অভিভাবকদের।
রাজধানীর ব্যয়বহুল কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর একটি স্কলাসটিকা। শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে কথা হয় এ স্কুলের এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, স্কলাসটিকায় ভর্তি হতে চাইলে প্রথমে ৫ হাজার টাকায় আবেদনপত্র কিনতে হবে। আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পর শিক্ষার্থী ভর্তিযোগ্য হলে প্লে শ্রেণির জন্য ভর্তি ফি বাবদ দুই লাখ টাকা জমা দিতে হবে। এর মধ্যে ৫০ হাজার টাকা ফেরতযোগ্য। এছাড়া, প্রতিমাসে টিউশন ফি বাবদ পরিশোধ করতে হবে ২০ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, স্কলাসটিকা স্কুলের মতই ভর্তি ফি রাখছে মাস্টারমাইন্ড স্কুল, ম্যাফল লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আগা খান স্কুল, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ইন্টারন্যাশনাল হোপ স্কুল, ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড স্কুলসহ বহুল পরিচিত স্কুলগুলো।
তবে তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল সেমি ইংলিশ ভার্সন ও বাংলা ভার্সনের কিন্ডারগার্টেনগুলো। এ স্কুলগুলোতে ভর্তিতে যাবতীয় ফি বাবদ শুরুতে দিতে হয় ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। উত্তরার জাহান স্কুলের ভর্তি ফি’র বিষয়ে জানতে চাইলে ওই স্কুলের দায়িত্বরত কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই স্কুলের মূল শাখায় ইংরেজি ভার্সনে প্লে শ্রেণিতে ভর্তি ফি বাবদ ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন ফি বাবদ শুরুতে আরও ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয় অভিভাবকদের। আর বাংলা ভার্সনে ভর্তি করাতে চাইলে সব মিলিয়ে ভর্তির সময় দিতে হয় ১৫ হাজার টাকা।’
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে সাড়ে ৩০০ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অনুমোদন আছে। কিন্তু শুধু রাজধানীতেই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে কয়েক হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল। সেগুলোর অধিকাংশই পাঠদান করছে বাংলা ও ইংলিশ ভার্সনে। তবে কয়েকজন অভিভাবক জানান, কিছু স্কুল ইংলিশ ভার্সনের কথা বলে অধিক ফি’তে ছাত্র ভর্তি করিয়ে পরে বাংলা ভার্সনেই পড়ায়।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকায় চাহিদার তুলনায় মানসম্মত সরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রচণ্ড অপ্রতুলতার কারণে বেসরকারি পর্যায়ে যত্রতত্র কিন্ডারগার্টেন স্কুল চালু হয়েছে। বাসস্থানের নিকটবর্তী হওয়ায় শিশুদের যাতায়াতের সুবিধা এবং নিরাপত্তার বিষয় চিন্তা করে অনেক অভিভাবকই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সন্তানকে এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করান।
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা বিষয়ে সরকারি কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এবং ব্যক্তিবিশেষের মর্জিমাফিকে এসব স্কুল পরিচালিত হওয়ার অভিযোগ পুরনো।
অভিভাবকরা জানান, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথম শ্রেণীতে পড়ার আগেই একটি শিশুকে প্লে, নার্সারি ও কেজি—এ তিনটি শ্রেণীতে মোট তিন বছর কাটাতে হয়। প্রতিবছরই প্রতিটি শিক্ষার্থীকে মোটা অঙ্কের ভর্তি ফিসহ নানা ধরনের চার্জ পরিশোধ করে নতুনভাবে ভর্তি হতে হয়।
স্কুলগুলো উচ্চ ভর্তি ফি, পরীক্ষা ফি, পরিবহন ফি তো গ্রহণ করছেই, এর সঙ্গে তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে বই-খাতা, ড্রেস ও জুতাসহ অন্যান্য উপকরণ অধিক মূল্যে কিনতেও বাধ্য করছে অভিভাবকদের। শুধু সন্তানদের শিক্ষা ও ভবিষ্যতের বিষয়টি চিন্তা করে অভিভাবকরা দীর্ঘদিন ধরে স্কুলগুলোর এমন আচরণ মেনে চলছে বলে জানান মনোয়ার হোসেন নামের এক অভিভাবক।
মনোয়ার হোসেন বলেন, অনেক স্কুলে কোনো কোনো বই দেওয়া হয়, যা শুধু অপ্রয়োজনীয় নয়, বরং শিশুদের শ্রেণী ও বয়স বিবেচনায় মোটেও মানানসই হয় না। শুধু তা-ই নয়, এসব শিশু শ্রেণীতেও প্রতি সপ্তাহে ‘ক্লাস টেস্ট’ ছাড়াও সারা বছরে মাসিক, দ্বি-মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক, বার্ষিক এবং টিউটোরিয়াল পরীক্ষার নামে মোট সাত-আটবার পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় এবং প্রত্যেক পরীক্ষার ফি আদায় করা হয়।
কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর পরিচালনা নীতি যে শুধু অভিভাবকদের ক্ষুব্ধ করছে তা নয়, এই স্কুলগুলোর কয়েকজন শিক্ষকও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ঢাকার একটি বহুল পরিচিত কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক শাহী রাজ বলেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে সরকারি ছুটি অনুসরণ করা হয় না। রমজান মাসেও ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণ করতে হয় শিক্ষকদের। তিনি বলেন, স্কুলগুলোতে শিক্ষক নিয়োগে ও বেতন-ভাতা প্রদানে কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণ করা হয় না।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে নারাজ কিন্ডারগার্টেনের পরিচালক ও মালিকরা। তবে, অভিযোগের বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক সমিতির এক নেতা জানান, কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো অনুদান নেই। স্কুলগুলো পরিচালিত হয় ভাড়া বাসায়। ফলে বাসা ভাড়া, শিক্ষকদের বেতন, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল মেটাতে বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয় প্রতিমাসে। এজন্য স্কুলগুলো ভর্তি ফি ও অন্যান্য ফিকিছুটা বেশি নিয়ে থাকে।
শিক্ষা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, শিশুদের উপর চাপিয়ে দেওয়া বইয়ের বোঝা ও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদানে কিন্ডারগার্টেনগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের পরামর্শ শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের। একইসঙ্গে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা আরও উন্নত ও সম্প্রসারণ করে শিক্ষায় রাষ্ট্রের অবদান বৃদ্ধির আহবান তাদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, কিন্ডারগার্টেনগুলোর শিক্ষার মান কিছুটা ভালো। সেখানে শিশুরা শিক্ষার পাশাপাশি অনেক এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। ফলে অভিভাবকদের মধ্যে যাদের অর্থ আছে তারাই কেবল এই স্কুলগুলোতে সন্তানদের ভর্তি করাতে সক্ষম হন।
তিনি আরও বলেন, সরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করা গেলে এই তারতম্য কমে আসবে। একইসঙ্গে একেবারেই নীতিমালার বাইরে কিন্ডারগার্টেনগুলোতে চলতে দেওয়া যায় না। একটা অভিন্ন নীতিমালা হওয়া দরকার। তাহলে সকলের পক্ষে শিক্ষার সমান সুযোগ তৈরী হবে। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস