প্রাইভেট না পড়লে শিক্ষার্থীরা অপ্রত্যাশিত সমস্যায় পড়ে
ঢাকাঃ জরিপকৃত তিন জেলা, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও এবং নীলফামারীর এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী ‘প্রাইভেট টিউটরের’ কাছে পড়ে। আর প্রাইভেট টিউটরের কাছে পাঠ না নিলে শিক্ষার্থীরা ‘অপ্রত্যাশিত সমস্যায়’ পড়ে। এমনকি প্রাইভেট টিউটরের কাছে না পড়লে শিক্ষার্থী ফেল করবে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জরিপে অংশ নেয়া উত্তরাঞ্চলের তিন জেলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। আর জাতীয় সম্মেলনে বক্তারা বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর কেন প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের কাছ থেকে শিশুরা শিক্ষা নিচ্ছে। শিক্ষকের চেয়ে শিক্ষার্থীর অনুপাত অনেক বেশি। এটাকে কমিয়ে আনতে হবে। চরাঞ্চলে প্রকসি শিক্ষক দিয়ে স্কুলগুলো চালানো হচ্ছে। শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের খরচ করা হচ্ছে না।
রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশে গতকাল এক জাতীয় সম্মেলনে সিপিডির জরিপে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। ‘প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগ, স্থানীয় অভিজ্ঞতা ও করণীয়’ শীর্ষক এ সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে জরিপের ফলাফল নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডিরি জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। বক্তব্য রাখেন, সংসদ সদস্য ও জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আক্তার, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, ইইউর শিক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও পাবলিক ফিন্যান্স ম্যানেজমেন্টের টিম লিডার ইউরাটে স্মালস্কাইটি মারভিলে, সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ সাঈদ রাশেদ আল জায়েদ যশ, ব্র্যাকের কর্মকর্তা সমীর রঞ্জন নাথ, ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ উজ জামান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের শিক্ষাবিষয়ক কর্মসূচি ব্যবস্থাপক নাদিয়া রশীদ প্রমুখ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম দেশের উত্তরাঞ্চলের তিনটি জেলা গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারীর ৩০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৪০৮ জনের ওপর জরিপ করে প্রাথমিক শিক্ষার এসব নানা তথ্য পেয়েছে।
সিপিডির উপস্থাপনায় তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, দারিদ্র্যের হার গাইবান্ধায় জাতীয় হারের প্রায় দ্বিগুণ। ঠাকুরগাঁও জেলায় এই হার জাতীয় হারের চেয়ে কম হলেও নীলফামারীতে আবার তা জাতীয় হারের চেয়ে প্রায় ৮ শতাংশ বেশি। ঠাকুরগাঁও জেলায় সাক্ষরতার হার জাতীয় হারের বেশি হলেও গাইবান্ধা ও নীলফামারীতে তা জাতীয় হারের চেয়ে কম। আবার গাইবান্ধা জেলায় বাল্যবিয়ের হার জাতীয় হারের চেয়ে প্রায় ১১ শতাংশ বেশি।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, জরিপ করা ৩০টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৪টিতে ৫টির কম শ্রেণিকক্ষ রয়েছে, যা প্রয়োজনের চেয়ে কম। আর শিক্ষকের গড় সংখ্যা ছিল ৬। সেখানকার শিক্ষার্থীর বিবেচনায় গড়ে ২৯ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক আছেন, যা জাতীয় হারের চেয়েও কম। কিন্তু সমস্যা হয় যখন কোনো শিক্ষক বদলি হন বা অনুপস্থিত থাকেন। তখন ক্লাস নিতে সমস্যা হয়। অন্যদিকে বিদ্যালয়গুলোতে অফিসসহায়ক না থাকায় প্রধান শিক্ষকের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। এর ফলে তিনি পাঠদান ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন না।
জরিপের তথ্য বলছে, ছাত্রছাত্রীদের জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা নেই বলে জানিয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ অংশীজন। জরিপ করা ৩০ বিদ্যালয়ের মধ্যে ২২টিতে কোনো ধরনের গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা নেই। ইংরেজি ও গণিত শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিশেষ দুর্বলতার কথা জানিয়েছেন জরিপে অংশ নেয়া অধিকাংশ উত্তরদাতা।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম প্রশ্ন রেখে বলেন, ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা করেন, কিন্তু সফলতার স্বীকৃতি দেবেন না? সবাই মিলে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, এখানে আপনারা যত সমস্যার কথা বলছেন, এসব থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু মানসিকতার কোনো উন্নতি হয়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য শিরীন আখতার বলেন, প্রাথমিক শিক্ষায় বাজেট দিন দিন বাড়ানো উচিত। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজের সন্তানদের ভর্তির ব্যাপারে সবার মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এখন স্কুল, ভবন হয়েছে, কিন্তু আমরা শিক্ষার্থী পাচ্ছি না। মাদরাসাগুলোতে শিক্ষার্থী যাচ্ছে। কারণ সন্তানকে মাদরাসায় পড়ালে বেহেস্তে যাওয়ার সুযোগ সহজ হবে।
ইইউর ইউরাটে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষা হলো গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এই খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। ১৬ শতাংশ ঝরে পড়া খুবই বেশি। এটাকে কমিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, বরাদ্দ ব্যবহারের দক্ষতা বাড়াতে হবে। ডিজিটালাইজেশন, গ্রিন এডুকেশন, জলবায়ু পরিবর্তন নতুন আলোচ্য বিষয়।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, গুণগত মানসম্মত শিক্ষকের প্রয়োজন। উন্নত মানের শিক্ষক দরকার। শিক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রে চাকরির সর্বশেষ পছন্দ হলে এগোনো যাবে না। শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রথম বা দ্বিতীয় পছন্দ হওয়া দরকার।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শিক্ষা খাতে আসলে নয়, এটি একটি বিনিয়োগ। আমরা যদি এই বিনিয়োগ করি তাহলে পরবর্তী সময়ে মিনিংফুল রিটার্ন দেবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে একটা বড় ধরনের বিভাজন হচ্ছে। আয় বৈষম্য ও সম্পদ বৈষম্য বাড়ছে।
সঞ্চালকের বক্তৃতায় ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশে স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষা জোরদার করার জন্য সরকারের উদ্যোগ আছে। আবার চ্যালেঞ্জও আছে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৬/০৬/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়