প্রসঙ্গ: জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষক আন্দোলন
আকমল হোসেনঃ ১১ জুলাই থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে মাধ্যমিক স্তরের একটি শিক্ষক সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির আহবানে লাগাতর অবস্থান কর্মসূচি চলছে। এর আগে সংগঠনটি থানা, জেলা, বিভাগীয় পর্যায়ে কর্মসূচি পালন করে এবং সরকারকে আন্দোলনের কর্মসূচি জানিয়েছিল। অবস্থান কর্মসূচি শুরুর দিনে পুলিশি অসহযোগিতা, মাইক ছিনিয়ে নেয়া; পরে দুই-একজন পুলিশের মারমুখী হওয়ার মধ্য দিয়ে ওই কর্মসূচি চলমান আছে।
শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবিটি ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি প্রথম করলেও আজ সেটি সব শিক্ষক সংগঠনের সাধারণ দাবিতে পরিণত হয়েছে। যদিও বিষয়টি সম্পকে সবাই পরিষ্কার নয়, সরকারতো নয়ই। সরকার নির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়াই বিক্ষিপ্তভাবে জাতীয়করণের তকমা দিয়ে যেটি করছে সেটি ¯্রফে সরকারিকরণ; যা শিক্ষকদের একাডেমিক ফ্রিডম হরণ করে সরকারি কর্মচারী হিসেবে তল্পিবাহকে পরিণত করছে; যার ফলে শিক্ষার মূল কাজই ব্যাহত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীদের কিছুটা আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত হলেও মর্যাদাগত দিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং বিশ্বায়নের আলোকে সব স্তরের শিক্ষক-কর্মচারীরা পিছিয়ে আছে।
আন্দোলনের চলমান অবস্থায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মাউশির ডিজি এবং পরে শিক্ষামন্ত্রী অনেকগুলো শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের ডেকে একটি বৈঠক করেছেন। প্রাচীনতম এবং দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসকারী শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে এটিই শিক্ষামন্ত্রীর প্রথম বৈঠক। তবে সরকারের প্রতি অতি আনুগত্যশীল এবং পেশাদারিত্ব বর্জিত সংগঠনের সঙ্গে তার বসার খবর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখা গেছে। সভা থেকে শিক্ষকদের আন্দোলন গুটিয়ে প্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়া, শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিতির বিষয়টি তদারকি করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও গভর্নিং বডিকে তৎপর হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা ও সভার সিদ্ধান্তে সরকারের প্রতি অতি আনুগত্যশীল শিক্ষক সংগঠনের নেতারা ছাড়া কেউ-ই খুশি হতে পারেনি। আন্দোলনকারী বিটিএ নেতারা তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের পরই তারা চলমান কর্মসূচির বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে শিক্ষক-কর্মচারীদের ১০টি সংগঠনের জোট শিক্ষক-কর্মচারী সমিতি ফেডারেশন যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাসহ শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের জন্য আন্দোলনে আছে, তারাও ইতোমধ্যেই সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের কর্মসূচি ঘোষণা করে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে তারা শিক্ষামন্ত্রীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসার প্রস্তুতিতে রয়েছেন। তাদের সবারই বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রী ছাড়া ডিজি বা শিক্ষামন্ত্রীর মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট কাটবে না।
শিক্ষা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হিসেবে পৃথিবীর দেশে দেশে গৃহীত হলেও বাংলাদেশে সেই স্বীকৃতি পায়নি, সংবিধানের ১৫ ধারায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৬ ধারায় নাগরিকের জন্য শিক্ষা লাভের অধিকার ঘোষণা করা হয়েছে। অন্ততপক্ষে প্রাথমিক ও মৌলিক পর্যায়ে শিক্ষা (১৮ বছর বয়স পর্যন্ত) অবৈতনিক হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সাধারণভাবে সহজলভ্য থাকবে এবং উচ্চতর শিক্ষা মেধার ভিত্তিতে সবার জন্য সমভাবে উন্মুক্ত থাকবে। এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণের পর জাতিসংঘ সব সদস্য রাষ্ট্রকে ঘোষণাপত্রের বিষয়বস্তু প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য আহবান জানায়। সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সবারই দায়িত্ব বর্তায় এগুলো বাস্তবায়নের জন্য; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানে সেটা কার্যকর হয়নি। তথাকথিত স্বাধীন পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত কোন সংবিধান প্রণয়ন সম্ভব হয়নি বরং পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের স্বার্থবিরোধী নানা কালাকানুন জারি করতে থাকে পাকিস্তানের শাসকেরা। শিক্ষা সংস্কৃতি ও রাজনীতি চর্চার পরিবর্তে পুলিশি রাষ্ট্র কায়েমের প্রক্রিয়া হিসেবে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এ সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন জনগণ এবং রাজনৈতিক মহলে প্রচ- ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই ১৯৬২ সালে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল।
বর্তমানে ২৬ হাজার প্রাইমারি স্কুলকে সরকারি করা হয়েছে; তবে এখনও ৪ হাজারের মতো প্রাইমারি স্কুল এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯০ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাকি রয়েছে; কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করে সেই সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থাকেও আবার সাম্প্রাদায়িক করা হয়েছিল, এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে। সংবিধানে একই ধারার সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের কথা থাকলেও বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা ও ইংরেজি মাধ্যমের (তিনধারার) শিক্ষা বহাল রয়েছে। শিক্ষায় অর্থায়ন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাড়েনি, শিক্ষা প্রশাসনে দলীয়করণের ভূত বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডিতে দলীয়করণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি বাদে সবগুলোতে দলীয়করণের ভূত চেপে বসেছে। ফলে দলীয়ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলায় তুলনামূলক কম যোগ্যতার লোক অগ্রাধিকার পাচ্ছে, ফলে শিক্ষার গুণগতমানের ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের টাকার কমিশন বণ্টনে সমঝোতা করতে দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালীদের।
শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষায় অর্থায়ন বৃদ্ধি করা জরুরি কিন্তু আমাদের দেশে দিন-দিন সেটা কমছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বরাদ্দ ছিল ১.৮০ % সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কমে ১,৭৬% হয়েছে। ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচনে ওয়াল্ড এডুকেশন ফোরামের সম্মেলনে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিব ১২ বছরের শিক্ষা রাষ্ট্রীয় খরচে করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিলেন, এসডিজি বাস্তবায়নে কোয়ালিটি ইকুইটিও ইনক্লুসিভ এডুকেশন বাস্তবায়নে পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক জিডিপির ৪.৪% বরাদ্দ প্রয়োজন বললেও বাজেট কমে ১.৭৬% হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, শিক্ষার্থীর ও শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন করে প্রতিষ্ঠানকে এমপিওকরণ, নতুন প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ, অবকাঠামোর উন্নয়ন, সব মিলিয়ে শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি হওয়ার কথা।
কিন্তু বৈষম্যের এখানেই শেষ নয়। যে টাকাই বরাদ্দ হয় তার একটা অংশ অব্যবহৃত থেকে যায়, আরেকটি অংশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ক্যাডেট শিক্ষায় চলে যায়, প্রকল্পের নামে আরেকটি অংশ তছরুপ হয়, সব মিলিয়ে বরাদ্দকৃত অর্থও ব্যয় হয় না। ১২ বছর আগে প্রণীত কারিকুলামের সৃজনশীল প্রদ্ধতি বাতিল করে নতুন করে অভিজ্ঞতাভিত্তিক পরীক্ষামূলক নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৭ বছরের একাডেমিক শিক্ষার মেয়াদ ও তার ফলাফলের মূল্যায়নের কাজ শেষ না করে কিভাবে সঠিক মূল্যায়ন হয় সেই বিষয়টি বিবেচনায় রাখা জরুরি। একাডেমিক বিষয়টি রাজনীতি আর ভোট ব্যাংকের সঙ্গে মিলাতে গেলে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে; সেই কারণেই খাদ্য, শিক্ষা আর স্বাস্থ্য বিষয়ে দলমত নির্বিশেষে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।
শিক্ষা প্রশাসনে একই কায়দায় পদায়ন করলে জি-হুজুর বলা অতি আনুগত্যশীল মানুষ পাওয়া যাবে তবে জাতি বঞ্চিত হবে। এ অধিকার হয়তো আমরা আমাদের অবস্থান থেকে কেউই রাখি না। গুণগত শিক্ষার জন্য গুণগতমানের শিক্ষক নিয়োগে বিকল্প নিয়োগ সংস্থা করায় অনেকটাই উন্নতি ঘটেছে; তবে প্রতিষ্ঠানসহ সব শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আদলে একটি নিয়োগ কমিশন করলে গুণগতমানের শিক্ষক পাওয়া সম্ভব; সেই সঙ্গে গভর্নিং বডির অযাচিত খবরদারি কমবে এবং চাঁদে-চাঁদে শিক্ষকদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। এসব বিষয় বিবেচনা করে শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণের দাবিটা সবারই কাক্সিক্ষত; আর সেই লক্ষ্যেই শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবি।
লেখক : কলেজ অধ্যক্ষ; যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২২/০৭/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়