প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি শহীদ মিনার থাকা প্রয়োজন
শিশু তার ভাষা শিক্ষার শুরু করে মায়ের মুখ থেকে শুনে এবং তার প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা শিক্ষা শুরু হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পর। বাড়িতে দীর্ঘদিন সে ভাষার নানা দিকের সাথে সে পরিচিত হয়। বর্ণমালার প্রাথমিক পরিচয় তার সম্পন্ন হয়। তারপর যখন সে প্রাক প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয় তখন তার শিখন প্রক্রিয়া শুরু হয় আনুষ্ঠানিকভাবে।
বর্ণের ব্যবহার, শব্দ তৈরি,শব্দ থেকে বাক্য তৈরি এবং বাংলা ভাষার মাধুর্যতার সাথে ক্রমেই তার পরিচিত ঘটতে থাকে। এভাবেই শিশু বড়হ য়। এখান থেকেই শিশু ভাষার প্রতি দায়িত্ববোধ এবং মমত্ববোধ তৈরি হতে থাকে। প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রæয়ারিতে ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা অংশ নেয়। ভাষা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তাদের বাংলা ভাষার সেই গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের সাথে পরিচয় ঘটতে থাকে।
তারা ক্রমেই জানতে পারে যে এই ভাষা একদিন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই ভাষার প্রতি যে দায়িত্ব রয়েছে তা তারা বুঝতে শেখে। আমাদের দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার থাকা প্রয়োজন। এতে ছাত্রছাত্রীরা ভাষার পেছনের সঠিক ইতিহাস জানতে আগ্রহী হবে এবং জানতে পারবে।
ভাষার প্রতি যে প্রেম থাকা প্রয়োজন তা অনুধাবন করতে পারবে। তবে দুঃখজনক হলো দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনার নেই। প্রতি বছর ফেব্রæয়ারিতে পত্রপত্রিকায় এ ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। অথচ শৈশব থেকে শেখাতে হবে এই ভাষা আমাদের মা,মাটি আর দেশের মতো ভালোবাসার বিষয়। বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে হবে, সঠিকতা বজায় রাখতে হবে এবং অপপ্রয়োগ রোধ করতে হবে। এই চর্চা আমাদের এই প্রজন্মকেই করতে হবে।
আজ বিভিন্নভাবে ভাষার যে বিকৃতি চলছে তা রোধ করতে ভাষার প্রতি মমত্ববোধ একান্ত প্রয়োজন। ’যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। দেশ ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুড়ায়, নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।
কবি আবদুল হাকিমের ’বঙ্গবাণী’ কবিতার এই চরণগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের মাতৃভাষা, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং যারা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে অথচ বাংলা ভাষার প্রতি মমতা নেই, তাদের বংশ ও পরিচয় সম্পর্কে কবির মনে সন্দেহ জাগে। আজ এই যে বাংলায় কথা বলার অনুভূতি, বাংলায় সাহিত্য চর্চার অনুভূতি তা প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষীর কাছেই আবেগের, শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার।
ভাষা হিসেবে বাংলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বিশে^ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। বাংলা বর্তমানে বিশে^ অন্যতম প্রভাবশালী ভাষাগুলো মধ্যে একটি। ভাষার মাধ্যমেই আমাদের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। পৃথিবীর আলো দেখার পর থেকেই মা এবং আশেপাশের মানুষের মুখে নানা ভাষা শুনে শিশু ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেটাই তার মাতৃভাষা।
সেই ভাষা চর্চার মধ্যে দিয়েই শিশু বড় হয়ে উঠতে থাকে। কোন দেশের জন্য, কোন জাতির জন্য ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাষার স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক। আমারা সৌভাগ্যবান যে আমাদের সেই স্বাধীনতা রয়েছে। আমাদের দেশে সারা বছর বাংলা নিয়ে চর্চা হবে। সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করার চেষ্টা করা হবে। স্কুল কলেজগুলোতে বাংলা ভাষা নিয়ে প্রচুর কাজ হবে। নানামুখী প্রতিযোগীতার মাধ্যমে এই চর্চা শুদ্ধভাবে এগিয়ে নেয়া যেতে পারে। মাথার ভেতর ইংরেজির গুরুত্ব মন্ত্রের মতো না ঢুকিয়ে দিয়ে বাংলার গুরুত্ব এবং দেশপ্রেম ঢুকিয়ে দিতে হবে। শুদ্ধ অন্তর দিয়ে যে ভাষাই আয়ত্ব করতে চাও না কেন তা সম্ভব ।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদদের সেই মহান আতœত্যাগ, সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি এসব কিছুই বাংলাকে নিয়ে গর্ব করার মত যথেষ্ট। এছাড়াও এ ভাষা নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাড়িয়ে বলার অনেক কিছু আছে। মাতৃভাষা অবহেলায় ফেলে বিদেশি ভাষা চর্চার গুরুত্বের আধিক্যের ফল শুভ হয় না। নিজ ভাষাকে প্রথমে জানতে হবে,বুঝতে হবে ও আতœস্থ করতে হবে। তারপর না বিদেশি ভাষা চর্চায় গতি আসবে।
তাই তো কবিগুরুর সাথে সুর মিলিয়ে বলি, আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর বিদেশি ভাষার পত্তন। শিশুকাল থেকেই সেই গাঁথুনি মজবুত করতে হবে। এজন্য চাই বাংলা ভাষার সেই ইতিহাস যা নিয়ে আমরা আজ গর্বিত, যে সংগ্রাম ও আতœত্যাগের কারণে আমরা বাংলা ভাষা নিজেদের করে পেয়েছি এবং যা পাকিস্থান শাসকগোষ্ঠাী জোর করে বদলে দিতে চেয়েছিল- সেই ইতিহাস তাদের জানাতে হবে, বোঝাতে হবে।
আর সেই ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার যা দেখে তারা শ্রদ্ধায় নত হয়ে আতœপ্রত্যয়ী হতে পারে বাংলাকে সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করার। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি শহীদ মিনার থাকার অর্থ হলো শিক্ষার্থী প্রতিদিন তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে শহীদ মিনার দেখবে এবং তার মনে দায়িত্ববোধের জন্ম নেবে।
লেখক- অলোক আচার্য
কলাম লেখক
পাবনা।