প্রকাশকদের দৈন্যদশায় বই মেলায় চটুল বইয়ে সয়লাব ?
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
সব বই কী বই? নাকি ছাপা হয়ে ফর্মায় ফর্মায় বেঁধে ফেললেই তাকে ‘বই’ বলা যায়! একভাবে বললে বই তো ‘বই’, আবার আরেকভাবে বললে- ‘সব বইকে তো ‘বই’ (মানসম্পন্ন) বলা যায় না। এ নিয়ে হয়তো যুক্তি-তর্কের অভাব থাকবে না। তবে প্রকৃত অর্থে যে বই একজন পাঠকের মনের মধ্যে চিন্তার খোরাক জোগাতে পারে না, যে বই মননশীলতার পরিচয় দিতে পারে না, গভীরভাবে মনে দাগ কাটতে পারে না কিংবা যে বই সৃষ্টিশীল ভূমিকা রাখতে পারে না- তাকে তো আর ‘মানসম্পন্ন বই’ বলা যায় না। এতকিছুর সমন্বয় থাকলে তবেই না কালজয়ী গল্প-উপন্যাসের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
সাহিত্য মানুষের রুচি, মান আর মনন তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে বলেই এখনও বাংলা সাহিত্যে গৌরবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘পথের পাঁচালী’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘লালসালু’ ‘খোয়াবনামা’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, সূর্য দীঘল বাড়ি, ‘আগুনপাখি, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, ‘সারেং বৌ’, ‘সংশপ্তক’ কিংবা ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর মতো বইগুলো। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে অমর একুশে বইমেলায় প্রতিবছর হাজার হাজার বই এলেও সেখান থেকে কতগুলো বই মানসম্পন্ন বই হয়ে থাকে! এবারে মেলায় প্রকাশিত বইগুলো থেকে ঠিক কতগুলো বই মানুষের চিন্তার খোরাক জোগাবে বা কতটি বই মানসম্মত সেটিও বিবেচ্য বিষয়।
বিশিষ্টজনরা জানান, কত বেশিসংখ্যক নতুন বই মেলায় আসছে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- মানের দিক থেকে কত গুরুত্বপূর্ণ নতুন বই বের হলো, কত বেশি ক্ল্যাসিক পুনর্মুদিত হলো, ছাপা, বাঁধাই প্রভৃতির মান কতটা উন্নত- তা-ই মূল বিবেচনার বিষয়। সাহিত্যবোদ্ধারা আরও জানান, ফেসবুকে কারও লাখ লাখ ফলোয়ার থাকলে কিংবা কেউ ‘ভাইরাল’ হলেই মেলায় তারা বই বের করে ফেলছেন। আর এ অনুসারীরা সেসব বই কিনতে প্রতিদিন ভিড় জমান মেলায়। আর এসব দেখেই তাদের বই প্রকাশে উৎসাহী হচ্ছেন অনেক প্রকাশক। আর এতেই সাহিত্যে অশনি সংকেত বেজে যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতি উত্তরণে বিশিষ্ট লেখকরা বলেন, কোনটা সাহিত্য আর কোনটা সাহিত্য নয়, সেটা বোঝা উচিত। কোনটা সৃজনশীল বই, কোনটা মননশীল বই আর কোনটা সৃজনশীল-মননশীল কোনো বর্গেই পড়ে না, সেটাও বোঝা উচিত। যত দিন পর্যন্ত না আমাদের প্রকাশকরা সচেতন হবেন, তত দিন পর্যন্ত একুশে বইমেলা এসব চটুল বইয়ে সয়লাবই থাকবে।
মেলায় আলোচিত-সমালোচিত এক দম্পতির বিষয় নিয়ে বই প্রকাশ করেছে মিজান প্রকাশনী। এই প্রকাশনীর প্রকাশক আ.ন.ম মিজানুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, যারা একটু সেলিব্রিটি, তাদের অনেককে আমি বলে রাখছি, ভাই তাড়াতাড়ি বই লিখেন। আপনার বই আমি প্রকাশ করব। আর লিখতে না পারলে আমাকে বলেন। আমরা প্রতিবছর ২৫ জন নতুন লেখকের বই প্রকাশ করি।’
প্রকাশ করার জন্য মানসম্মত বই না পেলে কি করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব বই মানসম্মত হবে এরকম তো কোনো কথা নেই। ২৫টার মধ্যে ১০টা ভালো হলে আর পাঁচটা ভালো বিক্রি হলেই হয়। বিক্রির জন্য পাঁচটি বই-ই যথেষ্ট। প্রয়োজনে আর ২০টি বই লস দিব। আমরা মূলত বিক্রিকেই প্রাধান্য দেই।’ আপনার প্রকাশনীর সম্পাদনা পরিষদ কয় সদস্যের জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাঁচ সদস্যের। তারা হলেন, ‘লেখক নুরুল হক আর এনায়েত রসুল।’ বাকি তিনজন কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যখন যাকে পাওয়া যায় তখন তাকে নিয়ে নেই।’
বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত জানতে চাইলে অন্বেষা প্রকাশনীর প্রকাশক শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘বই প্রকাশের ক্ষেত্রে বইয়ের বিষয়বস্তুর দিকে নজর দেওয়া উচিত। বইটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে কিনা বা বইটির বিষয়বস্তু পাঠকের উপযোগী কিনা সেসব বিষয় দেখে আমরা বই প্রকাশ করি। যেসব বই পাঠককে বিনোদনও দিবে না আবার কোনো জ্ঞানও অর্জন করা যাবে না সেসব বই কী কাজে লাগবে আমি জানিনা। আমরা সে ধরনের বই প্রকাশ করি না।’
তিনি বলেন, ‘ভাইরাল লেখকের বই কখনো টিকে থাকে না। তারা সাময়িকভাবে আসে আর কিছুদিন হইচই করে, এরপর হারিয়েও যায়। তাই এগুলো নিয়ে আমরা আশাহত না। যারা ভালো লেখক, যাদের বইয়ের কনটেন্ট ভালো, লেখায় শিল্পমান আছে, তাদের বই-ই টিকে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবার আসলে লেখক হওয়া উচিত না। ভালো লেখকের এখন পর্যাপ্ত অভাব। আমরা ভাষা আন্দোলন বা গবেষণাধর্মী কোনো বইয়ের পাণ্ডুলিপি পাই না। গল্প-উপন্যাসের দিকে না ঝুঁকে তরুণ প্রজন্মের বিষয়ভিত্তিক বইয়ের দিকে ঝোঁকা উচিত।’
আলোচিত-সমালোচিত ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর প্রথম বই বন্দিনি প্রকাশ করেছে আহমদ পাবলিশিং হাউজ। এই হাউজের পরিচালক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ডা. সাবরিনার বইয়ের লেখার মান ভালো। আমরা লেখা দেখেই বই প্রকাশ করেছি। বিক্রিও হয়েছে অনেক। সেলিব্রিটি ভাইরাল কি না এসব বিষয় আমাদের মূল লক্ষ্য না। আমাদের সম্পাদনা পরিষদ রয়েছে, তারা যাচাই-বাছাই করেই বই প্রকাশের জন্য নির্বাচিত করেন।’
মানসম্পন্ন বই প্রকাশে প্রকাশকের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে সময় প্রকাশনের প্রকাশক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘পাণ্ডুলিপি প্রকাশের বিষয়ে ব্যতিক্রমী বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়। আর লেখার মানের উপর প্রাধান্য থাকে সবচেয়ে বেশি। সে ক্ষেত্রে সম্পাদকের ভূমিকা অনেক পরে। প্রকাশক যখন বইটি ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সম্পাদকীয় বোর্ডের বিষয়টি আসবে। বই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রকাশকের ইচ্ছাটাই মুখ্য।
তবে সে ক্ষেত্রে কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বইটি বের করা হচ্ছে, সেটি হচ্ছে মূল বিষয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখি করার স্বাধীনতা সবার আছে। তবে লেখাটা কি আসলে প্রকাশের উপযুক্ত হলো কি না সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকের ভূমিকাই সব। কোন বইটি প্রকাশ করা হলো, সেটি পাঠক উপযোগী কি না সেটির দায়ভার যতটা না সেই লেখকের, তার বেশি যে বইটি বের করল সেই প্রকাশকের।’
অন্যপ্রকাশ প্রকাশনীর প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘সম্পাদনা ছাড়া আমরা কোনো বই প্রকাশ করি না। প্রকাশক যখন মনে করে বইটি প্রকাশের উপযোগী হয়, তখনই তা প্রিন্টে যায়।’
নতুন ও তরুণ লেখকদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের গণতান্ত্রিক দেশে বই লেখার অধিকার সবার আছে। সেটি পাঠক কিভাবে গ্রহণ করবে সেটি তাদের বিষয়। এখন অনেক বই-ই সম্পাদনা ছাড়া বের হচ্ছে। অনেক প্রকাশনীরই নিজস্ব সম্পাদকীয় বোর্ড নেই, প্রুফ রিডার নেই। প্রকাশকদের দৈন্যদশার কারণে এমনটা হচ্ছে। সাহিত্যের এই দিকটার খুবই করুণ দশা।’
শিবা/জামান-১৭.০২.২০২৪