পাঠ্যবই ছাপার জন্য অস্বাভাবিক কম দরে দরপত্র জমা!
নিউজ ডেস্ক।।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও ডলারের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় এ বছর অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কাগজ, কালি প্রভৃতি মুদ্রণসামগ্রীর দাম বেশি। অথচ ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপার জন্য প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কমে দরপত্র জমা দিয়েছে একাধিক মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান। অস্বাভাবিক কম দর দেখিয়ে তারা দরপত্র জমা দিয়েছে।
৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কম দামে দরপত্র জমা দিয়েছে একাধিক মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান। এই দরে কীভাবে কাজ করবে তারা তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বছরের মাত্র চার মাস বাকি। এখনো বই ছাপার কার্যাদেশ দিতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
জানতে চাইলে এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক উইংয়ের সদস্য (অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনকারী) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি ক্রয়নীতিমালায় (পিপিআর) সার্ভিসের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ দর দেওয়া দরদাতাকে কার্যাদেশ দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু গুডসের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই। যেহেতু আমাদের কাজগুলো গুডসের অধীনে, তাই সর্বনিম্ন দরদাতাকে বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। তবে তারা কম দরের মধ্যে কীভাবে কাজ তুলবে, সে বিষয়ে আমরা ব্যাখ্যা চেয়েছি। তাদের উত্তর জেনে আমরা একাধিক প্রস্তাব তৈরি করেছি।’
রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘প্রাথমিকের বই ছাপাবিষয়ক প্রস্তাব শিগগিরই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তারা যে প্রস্তাব অনুমোদন করবে, সেই অনুযায়ী কার্যাদেশ দেওয়া হবে। মাধ্যমিকের দরপত্রের দরপ্রস্তাবেরও মূল্যায়ন চলছে। সে ব্যাপারেও প্রস্তাব তৈরি করে শিগগিরই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে। আশা করছি, ডিসেম্বরের মধ্যেই সব বই স্কুলগুলোতে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।’
দরপত্রের শর্তানুযায়ী, প্রাথমিক স্তরের বইয়ে ৮০ শতাংশ জিএসএমের কাগজে ৮৫ শতাংশ ব্রাইটনেস থাকতে হয়। এ কাগজে প্রতি ফর্মা বই ছাপার সর্বোচ্চ প্রাক্কলিত দর ধরা হয়েছে ২ টাকা ৯০ পয়সা। কিন্তু কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতি ফর্মা বই ছাপার খরচ মাত্র ১ টাকা ৯০ পয়সা দেখিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। তাদের দেখানো দর প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৩৫ শতাংশ কম। কিছু প্রতিষ্ঠান খরচ ২ টাকা ৩০ পয়সা বা এর আশপাশে দেখিয়েছে, যা প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কম।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ৮০ জিএসএম ও ৮৫ ব্রাইটনেসের প্রতি টন কাগজের দাম বর্তমানে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। কিন্তু সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা টন ধরে দরপত্র জমা দিয়েছে। কালি, লেমিনেটিং ও বাঁধাইয়ের গ্লু প্রভৃতি উপকরণের দাম এখন চড়া। এ অবস্থায় প্রদর্শিত দামে কীভাবে কাজ করা সম্ভব তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
জানা যায়, গত বছর কাগজের দাম কিছুটা কম ছিল। সে জন্য সে বছরের একই মানের প্রাথমিকের বই ছাপার জন্য প্রতি ফর্মার প্রাক্কলিত দর ধরা হয়েছিল ২ টাকা ৭০ পয়সা। গত বছর যখন দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল, তখন সিন্ডিকেট করে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কম দরে দরপত্র জমা দিয়েছিল মুদ্রণকারীরা। পরে পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়। তাতেও গড়ে ফর্মাপ্রতি দর পড়েছিল ২ টাকা ২০ পয়সা। দুইবার দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করে কার্যাদেশ দিতে সময় লেগে যায়। কিছু কার্যাদেশ দেওয়া হয় সেপ্টেম্বরে আর কিছু কার্যাদেশ দেওয়া হয় অক্টোবরে। আর এ বছর কাগজ, কালি প্রভৃতির দাম বাড়ার পরও গত বছরের চেয়ে কম দর পড়েছে।
বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর কাগজ-কালির যে দাম তাতে প্রাথমিকের প্রতি ফর্মা বই ছাপতে নিট খরচ পড়বে ২ টাকা ৬০ পয়সা। দেখানো দরে কাজ করলে এক টাকাও লাভ হবে না। যদি ১০ শতাংশ লাভ করতে হয়, তাহলে ২ টাকা ৮৬ পয়সা দরে কাজ করতে হবে। দুই বছর ধরে যেভাবে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে তাতে ভালো কোনো প্রতিষ্ঠান এনসিটিবির কাজ করতে আসছে না। কারণ তাদের পক্ষে তো চুরি করে নিম্নমানের কাগজে বই দেওয়া সম্ভব নয়। এ বছর সর্বনিম্ন যে দর পড়েছে তাতে নির্ধারিত সময়ে নিউজপ্রিন্টেও বই দেওয়া সম্ভব হবে না। সরকার কিন্তু কম দরে কাজ করতে বলছে না, তারা শিক্ষার্থীদের হাতে মানসম্মত বই তুলে দিতে চায়। এনসিটিবি কেন যে বারবার সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ছে, তা আমরা বুঝতে পারছি না।’
২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানো হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার বই এবং মাধ্যমিক স্তরের ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার বই ছাপা হচ্ছে। প্রাথমিকের ৯৮টি লটের দরপত্র উন্মুক্ত করা হয় গত ১৩ জুন। ১৭টি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান ৯৮টি লটের সর্বনি¤œ দরদাতা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান আগের বছরও সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে। অনেকের বিরুদ্ধেই শেষ সময়ে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার অভিযোগ রয়েছে। যেসব বই দেশের দূর-দূরান্তে পাঠানো হয়েছে। গত বছর নিম্নমানের কাগজে বা নিউজপ্রিন্টে বই ছাপার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্তও করেছে এনসিটিবি। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান ভিন্ন নামে এবারও দরপত্রে অংশ নিয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এনসিটিবিতে যারা কর্মরত, তারা মূলত শিক্ষক। তাদের পদায়ন করা হয় মূলত কারিকুলাম নিয়ে কাজ করার জন্য। তারা কেন টেন্ডার করবেন? তারা কীভাবে বইয়ের মান যাচাই করবেন? এ দিকটা দেখা উচিত প্রিন্টিং কাজে যারা দক্ষ তাদের। প্রয়োজনে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এসব কাজ করা যেতে পারে। এ জন্যই আমরা এনসিটিবিকে বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলছি। একই সঙ্গে দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে এনসিটিবিকে পুনর্গঠন করা উচিত।’
অভিভাবকরা বলছেন, নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোয় বছরের ছয় মাস যেতে না যেতেই ছিঁড়ে যাচ্ছে বই। ছেঁড়া বই নিয়ে মহাবিপদে আছে শিক্ষার্থীরা। যেহেতু বিনামূল্যের বই লাইব্রেরিতে কিনতে পাওয়া যায় না, তাই কোনো রকম জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ সুজন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে যে বই দেওয়া হচ্ছে, তা পাঁচ-ছয় মাস পর পড়া যায় না। কাগজ ছিঁড়ে যাচ্ছে; বাইন্ডিং খুলে যায়। নানা কৌশলে এসব বই এক বছর টিকিয়ে রাখতে হয়। কয়েক বছর আগেও বইয়ের মান এমনটা ছিল না। আমরা এমন বই চাই, যা অন্তত এক বছর বাচ্চারা নির্বিঘ্নে পড়তে পারে। এ খাতে সরকারের বরাদ্দ ও তদারকি বাড়ানো উচিত।’
বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এত কম দামে ৮০ জিএসএম ও ৮৫ ব্রাইটনেসের কাগজে কীভাবে বই ছাপা সম্ভব, তা আমাদের বোধগম্য নয়। ফলে আগের মতোই এবারও কেউ কেউ নিউজপ্রিন্টে বই ছাপবে। আমরা বলেছিলাম, যারা প্রাক্কালিত দরের চেয়ে ১০ শতাংশ কম দর দিয়েছে, তাদের বিবেচনায় নিতে। তাহলে মানসম্মত বই পাওয়া সম্ভব হতো। যা-ই হোক, এনসিটিবির উচিত হবে দ্রুত কার্যাদেশ দেওয়া। নয়তো কাগজের দাম আরও বেড়ে গেলে সংকটে পড়তে হতে পারে।’