নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখলেই তারা বনে যান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
বাংলাদেশ রেলপথ মন্ত্রণালয়ে এমএলএসএস পদে চাকরির জন্য একটি অসাধু চক্রের সঙ্গে ১২ লাখ টাকায় চুক্তি হয় রাকিবের (ছদ্মনাম)। চক্রের সদস্য নাসিম মাহমুদের বড় ভাই মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন। খুব সহজে তিনি সেখানে চাকরি পাইয়ে দিতে পারবেন। নাসিমের এমন কথায় আশ্বস্ত হয়ে রাকিব তার শর্তে রাজি হন।
শর্ত মোতাবেক ব্লাঙ্ক চেক, ব্লাঙ্ক স্ট্যাম্প, সিভি ও ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম দেন রাকিব। গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে চাকরির ভাইভাও দেন। তখন চুক্তি মোতাবেক আরও দিতে হয় ৫০ শতাংশ টাকা (৬ লাখ)। ভাইভা শেষে রাকিবকে দেওয়া হয় নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড। ওই সময় পরিশোধ করতে হয় বাকি টাকা।
নিয়োগপত্র অনুসারে রাকিব রেলপথ মন্ত্রণালয়ে চাকরিতে যোগ দিতে গিয়ে জানতে পারেন, নিয়োগপত্রটি ভুয়া। পরে নাসিমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
রাকিবের মতো শতাধিক যুবকের সঙ্গে প্রতারণা করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে অসাধু এই চক্র। চক্রটি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখলে সঙ্গে সঙ্গে বনে যেত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কিংবা কর্মকর্তাদের নিকটাত্মীয়।
ডিবি জানায়, রেলপথ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কারা অধিদফতর, বিআরটিসি, বিএডিসি, ব্যাংক, মেট্রোরেল, এয়ারপোর্ট, তিতাস গ্যাস এবং সেনাবাহিনীর সিভিল পদে চাকরির বিজ্ঞাপন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশের পরই সক্রিয় হয়ে উঠত প্রতারক চক্রটি। সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে হাতিয়ে নিত বিপুল অর্থ।
এই চক্রের সদস্যরা ৩-৪ ধাপে কাজ করত।প্রথম ধাপে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর মাঠ পর্যায়ের চাকরি প্রার্থীদের আশ্বস্ত করা হতো। দ্বিতীয় ধাপে গ্রাম থেকে চাকরি প্রার্থীদের ঢাকায় এনে ভাইভা নেওয়া হতো। তৃতীয় ধাপে দেওয়া হতো নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড। চতুর্থ ধাপে চাকরিতে যোগদান করতে গিয়ে চাকরি প্রার্থীরা বুঝতে পারেন তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
এই প্রতারক চক্রের মূল হোতাসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। গ্রেফতাররা হলেন-ফরিদুল ইসলাম (২৯), নাসির চৌধুরী (৪৫), নাসিম মাহমুদ (৪৩) ও জুয়েল রানা (৪৫)। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ৪টি মোবাইল ফোন এবং বেশ কয়েকটি ভুয়া নিয়োগপত্র, চেক ও স্ট্যাম্প জব্দ করা হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি প্রধান) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গ্রেফতাররা বেশ কয়েক দিন ধরে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অনুসন্ধানে এই চক্রের বিভিন্ন ধাপ লক্ষ্য করা গেছে।
কোনো চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলেই চক্রের মাঠকর্মীরা চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছে গিয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করত। চাকরি প্রার্থী তাদের প্রস্তাবে রাজি হলে তাদের কাছ থেকে ব্লাঙ্ক চেক, ব্লাঙ্ক স্ট্যাম্প এবং সিভি সংগ্রহ করার পাশাপাশি মাঠকর্মীরা অগ্রিম হিসেবে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা নিত।’
তিনি বলেন, ‘মাঠকর্মীরা তাদের কমিশনের টাকা রেখে বাকি টাকা সিভি পর্যায়ের সাব এজেন্টের দিয়ে দিত। এই সাব এজেন্ট টাকা ও সিভি গ্রহণ করে সব চাকরি প্রার্থীকে নির্দিষ্ট দিনে ভাইভার জন্য ঢাকার এজেন্টের কাছে পাঠাত। পরে ঢাকার এজেন্ট আবাসিক হোটেলের রুমে বা সংশ্লিষ্ট দফতরের আশপাশের কোনো চায়ের দোকানে চাকরি প্রার্থীদের ভাইভা পরীক্ষা নিত। ভাইভায় উত্তীর্ণ হয়েছে দেখিয়ে প্রার্থীর কাছ থেকে চুক্তির ৫০ শতাংশ অর্থ গ্রহণ করত।
এরপর আরেক ধাপে চক্রের অন্য সদস্যরা চুক্তির বাকি টাকা গ্রহণ করে প্রার্থীকে নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড দিয়ে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট অফিসে গিয়ে চাকরিতে যোগ দিতে বলত। চাকরি প্রার্থী নিয়োগপত্রে উল্লিখিত তারিখে সংশ্লিষ্ট দফতরে চাকরিতে যোগ দিতে গিয়ে জানত সে প্রতারক চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছে।’
গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ডিবি প্রধান বলেন, ‘দুই-তিন বছর ধরে প্রতারণা করে আসছিল চক্রটি। তাদের ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চাকরিপ্রত্যাশীদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে প্রতারক চক্র টাকা হাতিয়ে নিত।’
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের টিম লিডার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. নাজমুল হক বলেন, ‘চক্রটি গত কয়েক বছরে চাকরিপ্রত্যাশী প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০-২০ লাখ টাকা করে নিলেও কাউকে চাকরি দিতে পারেনি। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/জামান/২৯.০৩.২৪