আশির দশকের মাঝামাঝি সময়। বলছি, দশপাখিয়ার কথা। যশোরের চৌগাছা উপজেলার নিভৃত একটি গ্রাম। সে সময় চলাচলের রাস্তা মানেই দিগন্ত বিস্তৃত মেঠোপথ। সে পথে বর্ষার কাদা যেমন ভোগাত, শীতে ধূলিকণাও তেমনি। পাকা রাস্তার দেখা মিলত দশ মাইল হাঁটা পথ পেরোলে। বড়জোর গরুর গাড়িতে যাতায়াতের সৌভাগ্য হতো কারও কারও; কারওবা ঘোড়ার গাড়িতে। বাকিদের ওই ধুলা-কাদায় মাখামাখি ছাড়া বিকল্প ছিল না।
গ্রামে লেখাপড়ার সুযোগ বলতে এক প্রাইমারি স্কুল। এরপর কলেজ তো দূর, হাইস্কুলের বারান্দায় দাঁড়াতে হলেও বেশ কয়েক মাইল পথ হেঁটে যাওয়া-আসা মেনে নেয়া। ছেলেদের হয়তো লজিং থাকার সুযোগ হতো; কিন্তু মেয়েদের বেলায়- হয় রোজ বেশ কয়েক মাইল হাঁটো, নইলে স্কুল ছাড়ো। দ্বিতীয় পথটাই বেছে নেয়া হতো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। সঙ্গত কারণেই দশপাখিয়া বা আশপাশের কোনো গ্রামের মেয়েদের মধ্য থেকে কেউ এসএসসি পাস করতে পারেনি তখন অবধি। আর শিক্ষার হার? সেটা গর্ব করে বলার মতো কিছু ছিল না অবশ্যই।
ঠিক সে সময় সর্বজনশ্রদ্ধেয় দশপাখিয়া গ্রামের এমএ পাস যুবক রবিউল ইসলাম আশপাশের কয়েক গ্রামের শিক্ষিত যুবকদের নিয়ে এগিয়ে এলেন। গ্রামবাসীর আন্তরিকতা আর নিজেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে তুললেন একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৯৮৬ সালে যাত্রা শুরু করল ‘দশপাখিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়’। শিক্ষক মোট নয়জন। রবিউল ইসলাম ২০১০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। শুরুতে স্কুলের ছাউনি হল খড়ের, আর মাটির উপর চাচের বেড়া। সামান্য বৃষ্টির তোড় সওয়াও সে স্থাপনার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে তাদের সন্তানদের স্কুলমুখী করাসহ শিক্ষকদের সংগ্রাম ছিল নানামুখী।
সে সময় ক্লাসরুমের অভাবে স্কুলের সামনের বটতলায় বেঞ্চ বসিয়েও চলত ক্লাস। যদিও শুরুর বছর ১৭ জন ছাত্রীসহ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০। গ্রামের মেয়েরা তো বটেই, ছেলেদের শিক্ষার হারও বাড়তে লাগল উল্লেখযোগ্য হারে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এ স্কুলে লেখাপড়া করার। ওই পাড়াগাঁয়ের স্কুল থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে আমি প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছিলাম। পরবর্তীকালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনায় পদচারণার সুযোগ পেয়েছে এ স্কুলের অনেকেই। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই কৃতিত্বের সঙ্গে ছাত্রজীবন সমাপ্ত করে কর্মজীবনেও সফলতার পরিচয় দিয়েছে। এলাকার নারী শিক্ষার উন্নয়নে বিদ্যালয়টির ভূমিকা ছিল অভাবনীয়। অনেক ছাত্রী উচ্চশিক্ষিত হয়ে চাকরিসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। এখন এ স্কুলের চার শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যাই বেশি।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এলাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় স্কুলটি। প্রতি বছর মহান স্বাধীনতা দিবসে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এলাকার সব বয়সের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। স্কুলের খেলার মাঠ বিকালে মুখরিত হয়ে ওঠে খেলাধুলা আর বিনোদনের আয়োজনে। এখন এ এলাকার মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা ও জীবনযাত্রার মান বেড়েছে অনেকগুণ। গ্রামীণ অবকাঠামোর অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময় গ্রামের অধিকাংশ রাস্তা পাকা হয়েছে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সে সময়ের মতো খালি পায়ে কোনো ছাত্রছাত্রীকে স্কুলে দেখা যায় না। এলাকার প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হয়েছে। বিদ্যালয়টিতে সরকারি অনুদানে দুটি ভবন স্থাপিত হয়েছে। দশপাখিয়ার মতো দেশের প্রতিটি গ্রামের নারীরা শিক্ষাক্ষেত্রে সফলতার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও তাদের সফলতার স্বাক্ষর রাখুক। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও নিজেদের সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হোক, এ প্রত্যাশা করি।
মো. তৌহিদুল ইসলাম : জনসংযোগ কর্মকর্তা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে পেজে লাইক দিয়ে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়।