নামসর্বস্ব হয়ে পড়েছে অর্ধশতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকাঃ দেশে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১২টি। এরপরও প্রতি বছরই নতুন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিচ্ছে সরকার। অথচ অর্ধশতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার ন্যূনতম মান নেই, শিক্ষকরাও মানহীন। ভাড়া বাড়িতে যত্রতত্রভাবে স্থাপিত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই অবকাঠামো, ল্যাবরেটরিসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ গবেষণা করা হলেও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানেন না গবেষণা কী। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে দিন দিন শিক্ষার্থীও কমছে। প্রতিনিয়তই রুগ্ণ থেকে রুগ্ণতর হচ্ছে দেশের অর্ধেকের বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে ও জেলা পর্যায়ে এমন কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেগুলোকে কোচিং সেন্টারের সঙ্গে তুলনা করলেও অনেক সময় ভুল হবে। মফস্বলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের বেতন ১০ হাজার। রাজধানীতেও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতন পান। ফলে নামকাওয়াস্তে কিছু শিক্ষক দিয়ে পড়ালেখা ছাড়াই নির্দিষ্ট সময়ে সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। সেখানে শিক্ষার্থীরাও নিয়মিত আসেন না, নিয়মিত পরীক্ষায়ও বসেন না। কিন্তু সার্টিফিকেটে দেখা যায়, ভালো জিপিএ নিয়ে পাস করেছেন।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ গবেষণা করা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। কিন্তু অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞাই পরিবর্তন করে দিয়েছে। গবেষণা কী তা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানেন না। নেই ল্যাবরেটরি, প্রয়োজনীয় ক্লাসরুম, সিনিয়র শিক্ষক, লাইব্রেরি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝেমধ্যে শিক্ষকরা এসে হাজিরা দিয়ে যান। আবার কিছু শিক্ষার্থী এলেও তাদের কোনোরকম একটা শিট ধরিয়ে দেওয়া হয়। যেহেতু ওই একই শিক্ষকরা পরীক্ষা নেন, খাতা দেখেন, প্রশাসনিক কার্যক্রমও বলতে গেলে তাদের হাতে। ফলে শিক্ষার্থীরা কিছু লিখলেই ভালো জিপিএ নিয়ে পাস করছেন। কিন্তু এসব শিক্ষার্থী চাকরির বাজারে গিয়ে বড় ধরনের বিপদে পড়ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি থাকায় ওইসব শিক্ষার্থী কোনো ধরনের ব্যবসা বা কারিগরি কাজেও যুক্ত হচ্ছেন না। দেশে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে গবেষণায় এক টাকাও ব্যয় করেনি ২৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আর ১০ লাখ টাকার নিচে ব্যয় করেছে ৪২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ৪২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরে কোনো গবেষণা নিবন্ধ বের হয়নি।
জানা যায়, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই গবেষণার খাতায় নাম ওঠাতে লোক দেখানো ব্যয় করেছে। যাতে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয় না তা কেউ বলতে না পারে। এজন্য তারা ছলচাতুরী করে গবেষণা খাতে ৫০ হাজার, ১ লাখ, ২ লাখ টাকার মতো ব্যয় করেছেন। এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০টিরও বেশি হবে। এগুলোতেই মূলত শিক্ষার মান নেই, শিক্ষকেরও মান নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের আট-দশটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে। এমনকি তিন-চারটি বিশ্ববিদ্যালয় বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও এগিয়ে গেছে। আরও ২০ থেকে ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মাঝারি মানে রয়েছে, তারা চেষ্টাও করছে। কিন্তু এর বাইরে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই কোনোরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।
প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি-আইইউবিএটি, আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক অন্যতম।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরও বলছেন, বছরের পর বছর ধরে প্রায় অর্ধশতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকলেও তা থেকে উত্তরণের কোনো চিন্তা ট্রাস্টিদের নেই। প্রতি বছরই নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারিতে শিক্ষার্থী কমছে। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন এমন ব্যক্তিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পেয়েছেন। আর এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিরা ভবিষ্যতে বড় ধরনের আয়ের সুযোগ দেখতে না পাওয়ায় মনোনিবেশ কমিয়ে দিয়েছেন। এতে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিন দিন টিউশন ফি কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এরপরও তারা শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। এতে যেমন অবকাঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে না আবার বেতন কম হওয়ায় ভালো শিক্ষকরা সেখানে যাচ্ছেন না।
সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা, সুবিধা-অসুবিধা দেখার জন্য বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি থাকলেও তাদেরও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই। সমিতির কাছে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই, নেই কোনো স্টাডি। তারা রুগ্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান বাড়াতে কোনো উদ্যোগই নিচ্ছেন না। এমনকি তারা মানোন্নয়নে বা অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের কাছেও সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব বা দাবিও জানাচ্ছেন না।
সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ পরিদর্শনে যান ইউজিসির একটি প্রতিনিধিদল। সেখানে তারা শিক্ষার ন্যূনতম পরিবেশ দেখতে পাননি। ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী ২৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের ভবন থাকার কথা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম ১০ থেকে ১২ হাজার বর্গফুট আয়তনের একটি জীর্ণ অবকাঠামোতে পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১৪টি প্রোগ্রামের অনুমোদন রয়েছে। সে হিসেবে কমপক্ষে ৭০ জন শিক্ষক থাকার কথা। অথচ আছেন ৩৩ জন। যাদের মধ্যে ২৪ জনই প্রভাষক। অধ্যাপক আছেন ১ জন, সহযোগী অধ্যাপক আছেন ১ জন ও সহকারী অধ্যাপক আছেন ৭ জন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক বেতন পান সাকুল্যে ১০ হাজার টাকা। তবে কয়েকজনকে ১২ হাজার টাকাও দেওয়া হয়। আর অধ্যাপক বেতন পান মাত্র ৩০ হাজার টাকা।
ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, ‘যেসব বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ালিটি মেইনটেইন করবে না, তারা অটোমেটিক ঝরে যাবে। ভালো শিক্ষক, অবকাঠামো না থাকলে তো শিক্ষার্থী আসবে না। বর্তমান ট্রাস্টিদের উচিত হবে তারা না পারলে ভালো শিক্ষা উদ্যোক্তাদের অংশীদার করা। যারা শিক্ষা বোঝেন তাদের ট্রাস্টি বোর্ডে না রাখতে পারলেও উপদেষ্টা হিসেবে রাখা। তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ দেওয়া। এছাড়া আইন মানার পাশাপাশি ইউজিসির নিয়মনীতি মেনে চলা। এতে তাদের মানের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।’
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৪/১১/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়